Read more
আদিবাসী সমাজে দাঁশায় পরব
সাঁওতালী সভ্যতার বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন নাচ-গানের কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি। সেগুলির মধ্যে সাঁওতাল সমাজে 'দাঁশায়’নাচ-গান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয় ‘শারদোৎসব' উপলক্ষ্যে। সাঁওতাল সমাজের ‘দাশায়’নাচ-গান সাঁওতালদের অন্যান্য উৎসব উপলক্ষ্যে নাচ-গানগুলির থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কেন না, সাঁওতালেরা তাদের ‘দাঁশায়' নাচ-গান ছাড়া অন্যান্য নাচ-গানে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ‘ধামসা’, ‘মাদল’, ‘ঢাক’, ‘রেগড়া’ প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। নাচে ছেলে ও মেয়ে উভয়ই অংশ নিতে পারে এবং ছেলেরা ছেলেদের মত ও মেয়েরা মেয়েদের মত পোষাক পরে। ঐ সকল উৎসব অনুষ্ঠানের গানগুলি 'হায়-হায়' দিয়ে শুরু হয় না। যদি না গানের মধ্য দিয়ে কোনও দুঃখের ঘটনা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘দাঁশায়’নাচ-গানের বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয় 'ভুয়াং' ও কাঁসার থালা। ‘ভুয়াং হচ্ছে লম্বা লাউ-এর খোলা, যা একখণ্ড বাঁশ মাঝখানে বাঁধা থাকে এবং বাঁশের দুই প্রান্তে দুটো দণ্ড লাগিয়ে ধনুকের ছিলার মত একটি দড়ি টান দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর দড়ি ধরে একটু টান দিয়ে ছাড়লেই একরকম শব্দ বেরিয়ে আসে, এই হলো ‘ভুয়াং’-এর কাঠামো। কাঁসার থালার উল্টো দিকে কাঠি দিয়ে আঘাত করলেই শব্দ হয়। ‘দাঁশায়’নাচ-গানে কেবলমাত্র ছেলেরাই অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ছেলেরা কিন্তু সম্পূর্ণ মেয়েদের সাজে সজ্জিত হয়ে ‘দাঁশায়’নাচে অংশ নেয়, অর্থাৎ ছদ্মবেশে থাকে এবং গানগুলি সব সময় হায়-হায় দিয় শুরু হয়। ‘দাঁশায়' নাচ-গানের সমস্ত প্রস্তুতি লক্ষ্য করলে মনে হবে, ওরা কোন এক যুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদল। এই নাচ দলের সঙ্গে একজন গুরু থাকে সেও থাকে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে। ‘দাঁশায়' নাচের দল যখন কারো বাড়ীতে প্রবেশ করে নাচ-গান শুরু করে এবং বাড়ীর সকলে যখন নাচ-গান দেখতে ব্যস্ত থাকে, তখন সেই বৃদ্ধ তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরবাড়ীর চতুর্দিকে লক্ষ্য করে। এই হলো 'দাশায়' নাচ দলের চেহারা। করা এবারে আমরা দেখি, সাঁওতালী সভ্যতায় ‘দাশায়’ নাচ গানের উদ্ভব নিয়ে সাঁওতালদের Tradition কি বলছে ? আদিবাসীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে 'সাঁওতাল' একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের “সাঁওতাল” এই নামটি তাদের নিজেদের দেওয়া নয়। তারা “সাঁওতাল” এই পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার পূর্বে, তারা খেরওয়াল বলে পরিচিত ছিল। এই খেরওয়াল গোষ্ঠীর মধ্যে আদিবাসীদের বিভিন্ন সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন— ‘সাঁওতাল’, ‘মুন্ডা’, ‘কোল’, ‘মাহালী’, ‘কড়া’ ‘শবর’ প্রভৃতি আরও বহু গোষ্ঠী। পরবর্তীকালে খেরওয়াল গোষ্ঠী থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ছোট ছোট আদিবাসী সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। খেরওয়াল গোষ্ঠীর বহু সম্প্রদায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে সম্পূর্ণ হিন্দু হয়ে যায়। আদিবাসীদের খেরওয়াল গোষ্ঠীর এই সম্প্রদায় যারা বর্তমানে সাঁওতাল বলে পরিচিত, তারা বহুকাল ধরে খেরওয়াল বলেই পরিচিত হয়ে আসছিল। পরবর্তীকালে তারা সাঁওতাল বলে পরিচিত হয়।
কথিত আছে, খেরওয়াল গোষ্ঠীর মানুষরা নাকি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের মাটিতে ‘পা’ দিয়েছিল। ভারতবর্ষের মাটিতে তারা বহু লড়াই করেছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মাটিতে সর্বপ্রথম যে লড়াই লড়েছিল, সেটা হচ্ছে কোন এক আর্য জাতির সঙ্গে। সেই সময় আর্যদের দলপতি ছিলেন ‘ইন্দ্ৰ’নামে কোন এক বীরপুরুষ এবং খেরওয়ালদের দলপতি ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘হুদুড় দুর্গা’। এই লড়াইয়ে ‘ইন্দ্র’ সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন এবং অবশিষ্ট সৈন্য-সামন্ত নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তারপর এই যুদ্ধের গরম হাওয়া ঠাণ্ডা হলে পরে ‘ইন্দ্র’ সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন ‘হুদুড় দুর্গা'র দরবারে। সেই সন্ধির প্রস্তাব ছিল, লড়াই যুদ্ধ থেকে বিরত থেকে বিবাহের সম্পর্ক গড়ে সন্ধি স্থাপন করা। এই প্রস্তাবে হুদুড় দুর্গা স্বীকৃতি দিলে পরে, ‘ইন্দ্র’ আর্যদের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে উপহার হিসাবে ‘হুদুড়-দুর্গা’কে দিয়েছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল দেবী। এই সন্ধি স্থাপনের পর আর্যরা যে কোন সময় বিনা অনুমতিতে ‘খেরওয়াল গড়’ এর অন্দরমহলে যাওয়া আসা করার সুযোগ পেল। এদিকে ‘দেবী’-কে ইন্দ্রের নির্দেশ ছিল ‘খেরওয়াড় গড়ে’-এর অন্দরমহলের খবর অর্থাৎ, ‘হুদুড় দুর্গা’ কখন খায়, কখন ঘুমায়, কোন সময় আনন্দ-স্ফূর্তিতে মেতে থাকে, কোন্ সময় মদের নেশায় বিভোর হয়ে থাকে, কোন্ সময় নেশায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থকে ইত্যাদি ইত্যাদি খবর প্রতিদিন নিয়মিত পাচার করা। ইন্দ্রের নির্দেশানুসারে ‘দেবী’ তাই করতে লাগল। ‘দেবী’কে তার স্বামী ‘হুদুড় দুর্গা’র কাছে বিশ্বাসঘাতক হতে হবে। ‘দেবী’ সেটা ভালোভাবেই জানত । সেক্ষেত্রে তার কিন্তু কোনও উপায় ছিল না কারণ এটা ইন্দ্রের নির্দেশ । এইভাবে বহুদিনের তথ্য মিলিয়ে ‘ইন্দ্ৰ’ দেখলেন যে, ঠিক এই সময়ে প্রতিদিনই রাত্রে ‘হুদুড় দুর্গা' নেশায় বিভোর হয়ে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকেন। সুযোগ বুঝে ‘ইন্দ্ৰ’কয়েকজন বীর যোদ্ধাকে অতিথি হিসাবে পাঠালেন ‘খেরওয়াল গড়ে’র অন্দরে আনন্দমহলে। 'দেবী' সমেত ‘হুদুড় দুর্গা’ দু-জনেই অপহৃত হলে পর, সমস্ত সৈন্য সামন্ত নিয়ে সেই রাত্রেই ‘ইন্দ্র’ আবার ‘খেরওয়াল গড়' আক্রমণ করলেন ফলে ‘খেরওয়াল গড়ে’র বাহিরে প্রহরারত সৈন্যরা লড়াই শুরু করেছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্দরমহলে ছুটে গেল 'হুদুড় দুর্গা'-কে খবর দিতে। কিন্তু তারা গিয়ে দেখল আনন্দমহল ফাঁকা। দেবী ও ‘হুদুড় দুর্গা’ কেউ-ই নেই। ফলে তারা ঘাবড়ে গেল। 'খেরওয়াল’ সৈন্যরা যুদ্ধ করলেও কেউ-ই সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারল না। ফলে তারা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলো এবং নারী- পুরুষ, ছেলেমেয়ে সকলেই পালিয়ে গিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নিল।
তারপর পরদিন সকাল হলে সভা ডেকে আলোচনা করল। তারা আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিল, ‘দেবী’ও ‘দুর্গা’-কে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করে উদ্ধার করতে হবে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ‘দেবী’ ও দুর্গা’-কে যেখানেই নিয়ে যাক, কেউ-ই তাদেরকে মারতে পারবে না। কিন্তু তারা জানত না যে, ‘দেবী’ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং দুর্গাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
তারা আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিল, তারা ‘দেবী’ও দুর্গা'র সন্ধানে যাবে সম্পূর্ণ ছদ্মবেশে, অস্ত্রশস্ত্র গোপনে সঙ্গে থাকবে। তারা তৈরী হয়েই যাবে, যেখানেই তারা তাদের সন্ধান পাবে, সেখানেই লড়াই করে তাদেরকে উদ্ধার করবে। তাই সমস্ত যোদ্ধারা সম্পূর্ণ মেয়েদের বেশে সজ্জিত হলো। তারা তাদের তীরগুলিকে লুকিয়ে রাখল 'ভুয়াং-এর মধ্যে অর্থাৎ লম্বা লাউ-এর খোলার মধ্যে। এবং সেই লম্বা লাউ-এর খোলাকে তারা বেঁধে রাখলো ধনুকের সঙ্গে। যাদের তীর ধনুক ছিল না, তারা তাদের তলোয়ারকে শাড়ীর কোঁচার মধ্যে লুকিয়ে রাখল এবং ঢাল হাতে ধরে কাঠি দিয়ে ‘ভুয়াং’-এর শব্দের তালে বাজাতে লাগল ।
এইভাবে সম্পূর্ণ নতুন পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী হলো খেরওয়াল সৈন্যরা, ‘দেবী” ও ‘দুর্গা’-কে খুঁজে বের করে উদ্ধার করার জন্য। ঐ সময় খেরওয়াল সমাজের সাতজন প্রধান গুরু ছিলেন। সমস্ত সৈন্যরা সাতটি দলে বিভক্ত হলো এবং এক একটি দল এক একটি গুরুর অধীনে থেকে গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়ল নাচ-গান আনন্দের নয়, এটা তাদের কাছে খুবই দুঃখের।
তাদের এই দুঃখের দিনে ‘হায় হায়’করতে করতে নাচ-গান দেখিয়ে ভিক্ষা চাওয়ার অজুহাতে প্রত্যেক ঘরে ঘরে যেতে লাগল। তাদের এই নাচ-গান শুধু অজুহাত মাত্র, উদ্দেশ্য ছিল অপহৃত ‘দেবী ও দুর্গা'-কে খুঁজে বের করে উদ্ধার করা। কিন্তু তারা তাদেরকে কোথাও খুঁজে পায়নি। এখনো সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক তাদের সেই মহান দলপতি ‘হুদুড় দুর্গা' ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনীকে হায় হায় করতে করতে খুঁজে চলেছে। আমরা নীচের একটি ‘দাঁশায়’ গানের মধ্য দিয়ে উপরোক্ত ঘটনার কিছুটা আভাস পেতে পারি।
হায়রে হায়রে-
দেবী রে দুর্গা দকিন অডোং এনারে,
দেবী রে দুর্গা দ কিন বাহের এনারে।
হায়রে হায়রে-
চেতে লাগিদ গুরু কিন অডোং এনারে,
চেতে লাগিদ গুরু কিন বাহের এনারে?
হায়রে হায়রে—
দেশ লাগিদ চেলা কিন অডোং এনারে,
দিশম লাগিদ চেলা কিন বাহের এনারে।
অর্থাৎ—
হায়রে হায়রে-
‘দেবী ও ‘দুর্গা’ দু-জনে চলে গেছে,
‘দেবী’ ও ‘দুর্গা’ দু-জনে বেরিয়ে গেছে।
হায়রে হায়রে-
হে গুরু ওরা দু-জনে কেন চলে গেছে,
হে গুরু ওরা দু-জনে কেন বেরিয়ে গেছে?
** হায়রে হায়রে-
১৯৯৬ ও শিষ্যগণ ওরা দু-জনে এই দেশের জন্যই চলে গেছে, ও শিষ্যগণ ওরা দু-জনে এই মাটির জন্যই বেরিয়ে গেছে।
0 Reviews