খেরওয়াড় থেকে ঝাড়খণ্ডী

খেরওয়াড় থেকে ঝাড়খণ্ডী

Size

Read more

 খেরওয়াড় থেকে ঝাড়খণ্ডী










ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় বাংলার মাটিতে, বলা যায় ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম যে নরগোষ্ঠী বসবাস করত নৃ-বিজ্ঞানীরা তাদের নাম দিয়েছেন ‘প্রোটো-অস্ট্রালয়েড’ গোষ্ঠী। এরপর ভারতবর্ষের মাটিতে আসে দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর মানুষ। কালক্রমে আসে আলপীয় নরগোষ্ঠীর মানুষজন। এই আলপীয় নরগোষ্ঠী আসার পরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল বৈদিক সংস্কৃতবাহী আর্য ভাষাভাষী নর্ডিক নরগোষ্ঠী। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রথম ও প্রকৃত আদিম অধিবাসীরা হলেন ‘প্রোটো-অস্ট্রালয়েড' নরগোষ্ঠীর মানুষ।

আরও জানা যাচ্ছে, তাঁরা যে ভাষায় কথা বলতেন তাকে 'অষ্ট্রিক ভাষা' বলা যায়। এই ভাষার বিস্তৃতি ছিল পাঞ্জাব থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। প্রাক্-আর্য ভারতের মাটিতে যে বিশাল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা অস্ট্রিক সভ্যতা। অস্ট্রিক ভাষী মানুষের সভ্যতা। ভাবতে অবাক লাগে আজও এই ভাষার অস্তিত্ব ভারতের মাটিতে টিকে আছে। হারিয়ে যায় নি। ভারতীয় ভাষাবিদ্রা জানাচ্ছেন, ভারতে এই অস্ট্রিক ভাষার বর্তমান প্রতিভূ হচ্ছে ‘মুণ্ডা' ভাষা, যে ভাষায় সাঁওতাল, ভীল, কুরুম্ব, কোরওয়া, জুয়াঙ, কোরকু প্রভৃ তি সম্প্রদায়ের মানুষ কথা বলেন। অপরপক্ষে, এ সিদ্ধান্তে আসা যায়, বাংলা তথা ভারতের আদিম অধিবাসীরা হলেন—সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, ভূমিজ, মাহালি, লোধ, শবর, কোড়া, প্রভৃতি অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন। ভারতবর্ষের ইতিহাস গণনা শুরু হয় তথাকথিত আর্যরা ভারতে আসার পর থেকে। কিন্তু তারও বহু আগে এখানকার আদিম অধিবাসীদের পরিচয় স্পষ্টভাবে জানা যায় না। প্রাক্-আৰ্য এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষ কি নামে পরিচিত ছিল তা নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।

"Linguistic Survey of India " গ্রন্থ G A. Grierson লিখেছেন— “Santali, Mundari, Bhumij, Koda, Ho, Turi and Korwa are only slightly differing forms of one and the same language. All these Tribes are accounting to Santali traditions descended from the same stock and were once known as Kherwars or Kharwasrs. " সুতরাং দেখা যাচ্ছে, G. A. Grierson যে সমস্ত কথা বলেছেন, এই প্রবন্ধের শুরুতে তাঁদের ভারতের আদিম অধিবাসী হিসেবে বলা হয়েছে। এঁরা 'খেরওয়াড়' বা খারওয়াড় জনগোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। এরা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘খেরওয়াড়’ বা 'খারওয়াড়' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও নিজেদের 'খেরওয়াল' নামে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ‘খেরওয়াল’ শব্দ ‘খেরওয়াড়’ বা ‘খারওয়াড়’ থেকেই আগত এ বিষয়ে পণ্ডিত কোলেয়ান হাড়াম কথিত এবং Srefsrued লিখিত “হড় রেন মারে হাপড়াম কো রেয়াঃ কাথা” গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়—চাম্পা ধাবিচ্ আলে আর মুণ্ডাকো, বিরহড়কো, কুঁড়বিকো এ্যমানতেনকো খারওয়ার ত্রুতুম তেলে বিকাউঃক কান তাঁহেকানা........।” অর্থাৎ “চম্পা পর্যন্ত আমরা এবং মুণ্ডারা, কুড়মিরা, বিরহড়রা এবং আরো অনেকেই খারওয়ার নামে অভিহিত হতাম।” এই গ্রন্থ অনুযায়ী, চাম্পা নামক স্থানে অবস্থানকালীন পর্যন্ত এই বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের খারওয়ার নামে অভিহিত করতেন। তৎকালীন বা প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক সীমায় এই 'চম্পা' নামক স্থানের অবস্থান নির্ণয় করতে পারলে, খেরওয়ার জনগোষ্ঠীর সময় সীমা সম্পর্কেও মোটামুটি একটা ধারণা করা যেতে পারে।

Timothy Tilka Murmu তাঁর "The Adivasis Past and Present" গ্রন্থে লিখেছেন— "They occupied the whole Indus Valley. The Lower Indus Valley roughly corresponding to modern Sind was then called 'Chae' and thence forth the occupied territories were always called jointly by two names 'Chae Champa'." চায় চম্পা বলতে সিন্ধু উপত্যকাকে বোঝায় । সাঁওতালী প্রাচীন গানে 'কান্দাহার' স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ‘কান্দাহার’ সিন্ধু উপত্যকারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং বলা যায় সিন্ধু উপত্যকায় খেরওয়ারদের বসবাস ছিল এবং এই উপত্যকার নাম তারা রেখেছিল 'চায়-চম্পা'। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল বিশাল সভ্যতা যা সিন্ধু সভ্যতা নামে চিহ্নিত। তাহলে তো অবশ্যই বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা আসলে অস্ট্রিকদের সভ্যতা বা খেরওয়ারদের সভ্যতা। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল আর্যরা আসার বহু আগে। অতএব একথা জোর করেই বলা যায়, প্রাক্-আর্য যুগে ভারতের মাটিতে যে আদিম অধিবাসীরা বসবাস করত—যারা বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, তারা আসলে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর মানুষ। সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত এক একটি তথ্য বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, এই সভ্যতা আসলে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা বা অস্ট্রিক সভ্যতা।

"Austric Civilization of India" গ্রন্থে N. Hembram লিখেছেন— “The human skulls found from the excavation did prove that the race belonged to Proto-Australoid-that was the race of Austric people. Once we analyse the basic tenets of the Indian culture, we find that a lot of it is still 

prevalent amongst the Santals which indicates that Indian culture had all along been very much advanced starting from Indus Valley Civilization till-today. "Since the Austric people are the progenitors of such a unique and advanced culture, this should now be called Austric Civilization." সিন্ধু সভ্যতা যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের জীবনাচরণের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে জানা যায়, খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর মানুষদের জীবনাচরণের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সুতরাং একথা কেন বলা যাবে না যে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলতঃ খেরওয়াড় সভ্যতা। ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ কেন যে এই নামে অভিহিত করলেন না, এ অভিসন্ধি বোঝা খুব কঠিন। যাইহোক, খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর মানুষ কেবল যে সিন্ধু উপত্যকায় বসবাস করত তা নয়, ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্তও জনবসতি গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থে খেরওয়াড়দের উল্লেখ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন-

"Descriptive Ethnology of Bengal" গ্রন্থে E. T. Dalton লিখেছেন— "I have already observed that the Gangetic Provinces were in all probability once occupied by a people speaking Munda and Kolarian Language and of this the latest dominant Tribe were the Chorus...... The Kols spoken in all probability were Kharwars.......Beechanan estimated the Kharwars of Sahabad at 1,50,000. They are still more numerous in the district of Chutia Nagpur, especially in the Palamau and Ramgarh estates and a large proportion of the land gently are Kharwars."

"JOURNAL OF FRANCIS BUCHANAN" থেকে জানা যায় "The Kharwars of Chutiangar, accordingly to Risley (T & C of Bengal) claim Rohtasgarh as their original seat. This probably means that before moving eastwards in Chotanagpur they occupied the Rohtas plateau, as the general tradition among the Kaimur Kharwars appears to be that they came from still further west." রাজস্থানে যে সমস্ত জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে এসেছে তাঁদের একটা তালিকা দিয়েছেন James Tod "Annals and Antiquities of Rajasthan" "From Gajuni came the Gehlote, the Tak from Aser..........Jirgah the Kherwar....." 


অর্থাৎ জিরগা থেকে খেরওয়াররা রাজস্থানে এসেছে। 'জিরগা'র ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের উত্তর-পশ্চিম অর্থাৎ সিন্ধু উপত্যকার মধ্যে হওয়াই স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত আলোচনায় জানা গেল, প্রাক্-আয যুগে ভারতে যে আদিম জনগোষ্ঠী বসবাস করত তারা হল খেরওয়ার জনগোষ্ঠী।

ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, এবার বৈদিক যুগ সম্পর্ক আলোচনা করা যাক্ ২০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে তথাকথিত আর্যরা ভারতে এসেছিল। তখন ভারতে খেরওয়ার সভ্যতার হাওয়া চলছে। যাযাবর শ্রেণীভুক্ত আর্যরা বুঝতে পেরেছিল এই খেরওয়াড়দের পর্যুদস্ত করতে না পারলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা তাদের পক্ষে দুরুহ। তাই খেরওয়ার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বহু বছর ধরে তাদের লড়াই চলেছিল এবং আর্যরা আস্তে আস্তে সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা দখল করেছিল। প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য মত এটাই যে, আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে এদেশে এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন ফর্সা আর এদেশের প্রাচীন অধিবাসী অর্থাৎ খেরওয়ারা ছিলেন কালো। স্বাভাবিক কারণে এই সব কালো মানুষের দল ফর্সা আর্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সংহিতার যুগ শেষ হওয়ার আগেই কালো মানুষেরা ফর্সাদের কাছে বিজিত হন। বিজিত হওয়ার পর কালো মানুষদের অর্থাৎ খেরওয়ারদের নাম দেওয়া হল শূদ্র। শূদ্রদের আর এক নাম অনার্য। খেরওয়ারদের পরিচিতি হল শূদ্র নামে। অনার্য নামে। কালক্রমে আর্যসমাজ তিন বর্ণে বিভক্ত হল—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। পরবর্তী সময়ে সবার শেষে শূদ্রদের নিয়ে ভারতীয় সমাজ চার বর্ণে বিভক্ত হয়ে গেল। বৈদিক সাহিত্যে সুপণ্ডিত পাণ্ডুরং বমন কানের মতে, বর্ণাশ্রমের সূত্রপাত হয়েছিল ফর্সা এবং কালো—এই দু'রকম গায়ের রং এবং সামাজিক রীতিনীতি অর্থাৎ নৃ-তাত্ত্বিক পার্থক্যের ভিত্তিতে। আগেই বলা হয়েছে, দেশের ভিতরে আর্যরা যতই এগিয়েছেন ততই তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এদেশ থেকে অনার্যদের নির্মূল করা কোন মতেই সম্ভব নয়। কারণ, অনার্যদের তুলনায় তাঁরা ছিলেন নিতান্তই সংখ্যালঘু। তাই বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে অনার্যদের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কালক্রমে এদেশে স্থাপিত হল আর্য-সাম্রাজ্য আর অনার্যদের মধ্যে আর্যরা রাজা জাতি হিসাবে প্রভুত্ব লাভ করলেন। তারপরই শুরু হল অনার্যদের তথা খেরওয়াদের আর্যীকরণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার প্রধান হাতিয়ার ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি, এককথায় যাকে বলা যেতে পারে ব্রাহ্মণ্যবাদ। খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর সবাই যে সমমাত্রায় আর্যীকৃত হয়েছিলেন এমন নয়। এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ ব্রাহ্মণ্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে রয়ে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, এঁরাই নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ভাষাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। যদিও পরবর্তী সময়ে আর্যীকৃত বহির্ভূত খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর বড় অংশ অন্যান্য ধর্মের আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল তথাপি যাঁরা নিজস্বতার বৈভবকে আঁকড়ে রেখেছিলেন তাঁরাই আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন গোষ্ঠীর সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার কাঠামোকে। এঁদের অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য। যাইহোক, ফিরে আসি বৈদিক আমলের কথায়। আর্য-অনার্যদের দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে ছিল জীবন-মরণের সংগ্রাম। এই সংগ্রামে বলতে দ্বিধা নেই অনেক অনার্য গোষ্ঠীই শেষ হয়ে যান। বৈদিক আর্যগণ পঞ্চ নদের উপত্যকায় উপনিবেশ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হলেন না। অনার্যদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করে তাঁরা ক্রমশ ভারতের পূর্বদিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। যেমন যেমন অগ্রসর হয়েছেন তেমন তেমন তারা উত্তর ভারতের আর্য-প্রভাবান্বিত অঞ্চল সমূহের নামকরণ করেছেন। যেমন—ব্রহ্মর্ষিদেশ, ব্রহ্মাবর্ত, আর্যাবর্ত ইত্যাদি। পূর্ব ভারতের মগধ পর্যন্ত ছিল আর্যদের আধিপত্য। আসলে আর্যরা ছিলেন চারদিকে বিক্ষুব্ধ অনার্য দ্বারা বেষ্টিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। অনার্যদের প্রতি তাঁদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিল অপরিসীম। তাই তাঁরা অনার্যদের একাধিক ঘৃণাবাচক নাম দিয়েছিলেন। যেমন—দাস, দস্যু, অসুর, রাক্ষস, দৈত্য, দানব ইত্যাদি। অনার্যদের সঙ্গে আর্যদের সম্পর্ক যে কত খারাপ ছিল তার নিদর্শন ঋগ্বেদে অজস্র পাওয়া যায়। আর্য ঋষিরা অনার্যদের মৃত্যু কামনা করে প্রার্থনা করেছেন—“হে ইন্দ্র ও সোম, তোমরা রাক্ষসগণকে শাস্ত্রী প্রদান কর। অন্ধকার দ্বারা বর্ধমান রাক্ষসদিগকে নীচ করিয়া দাও। জ্ঞানরহিত রাক্ষসগণকে পরান্মুখ করিয়া হিংসা কর, দগ্ধ কর, মারিয়া ফেল, দূর করিয়া দাও, ভক্ষক রাক্ষসগণকে কৃশ করিয়া ফেল। অন্তরীক্ষ হইতে বধ কর, আয়ুধ উৎপাদন কর। হে ইন্দ্র ... আমাদের চতুর্দিকে দাস জাতি আছে...... তাহারা মানুষের মধ্যেই নয়। হে শত্রু সংহারকারী, তাহাদিগকে নিধন কর, সেই দাস জাতিকে হিংসা কর।*)  ডাক আসল কথা হল, অনার্যদের সঙ্গে আর্যদের সম্পর্কটা ছিল বিজেতা ও বিজিতের। বিজিত হওয়ার পরিণামে অনার্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা :) লুপ্ত হয়। তার ফলে অনার্যদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা ধর্মশাস্ত্রের বিধানগুলি :) থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন—বিচারক সভাসদ কিংবা রাজার উপদেষ্টা পদে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ না পাওয়া গেলে নামমাত্র ব্রাহ্মণ হলেও চলবে। ব্রাহ্মণের অভাবে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য হলেও চলতে পারে কিন্তু সর্বগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শুদ্রকে দিয়ে এসব কাজ করানো চলবে না (মনুসংহিতা এবং ক্যাত্যায়ণের ধর্মশাস্ত্র)। ধর্মশাস্ত্র প্রণেতাদের মধ্যে বলা হয় মনুই বিখ্যাত। তিনি শুদ্রদের কর্তব্য সম্পর্কে তো বলেইছেন, এমনকি তাদের জীবনযাত্রা প্রণালীও ছকে দিয়েছেন এভাবে—“তাদের (শূদ্রদের) খেতে দেবে উচ্ছিষ্ট অন্ন, পরতে দেবে জীর্ণ বসন, শুতে দেবে খড়ের উপর কিংবা বড় জোর ছেঁড়া কাঁথায়।” (মনুসংহিতা)।


এতকাণ্ডের পরেও মন নিশ্চিত হতে পারলেন না। পাছে শূদ্রদের হাতে কোনও ভাবে ধন-সম্পত্তি এসে যায় তাই তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন—“ধন উপার্জনে সক্ষম হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চ য় করতে দেওয়া চলবে না; কেন না শূদ্র ধন সঞ্চ য় করলে ব্রাহ্মণের বড় কষ্ট হয়” (মনুসংহিতা)। সে যুগে শিক্ষা বলতে প্রধানতঃ বোঝাত বেদ-বেদাঙ্গ প্রভৃতির অধ্যয়ণ ও জ্ঞানার্জন করা। শূদ্রদের জন্য বেদপাঠ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বেদান্ত সূত্রে বলা হল—দেব নির্ভর ব্রহ্মবিদ্যায় শূদ্রের কোন অধিকার নেই। গৌতম তাঁর ধর্মশাস্ত্রে আরও কঠোর বিধান দিলেন যে, মুখস্ত করার মতলবে যদি কোনও শূদ্র বেদপাঠ শোনে তার কান সীসা কিংবা গালা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত; আর যদি কোন শূদ্র বেদবাক্য উচ্চারণ করে তাহলে তার জিভ কেটে ফেলবে।

শ্রীধীরেন্দ্রনাথ বাসকে তাঁর “বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক্-বৈদিক প্রভাব” গ্রন্থে লিখেছেন—“আর্যরা এদেশের অনার্য গো? গুলিকে দাস, দস্যু, অসুর বলে অভিহিত করত। ঋগ্বেদ সংহিতার “বিজানীহি আর্য্যান যে চ দসব্যঃ” “অয়মেতি বিচাকদ বিচিন্তন দাস আৰ্য্যম” ইত্যাদি কথা থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। খারওয়াড় বা খেরওয়ালরা এরই প্রতিবাদে নিজেদের “হড়” অর্থাৎ মানুষ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছিল এবং আজ পর্যন্ত তারা নিজেদের ঐ নামেই পরিচয় দিয়ে আসছে।...............পরবর্তীকালে খেরওয়াল গোষ্ঠী নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। খেরওয়াল গোষ্ঠী তখন কতকগুলি শাখায় বিভক্ত হয়েছিল তা বলা শক্ত। তবে, এখন ভাষার বৈশিষ্ট্য ধরে বিচার করলে দেখা যায়, এগুলি এক সময় খেরওয়াল জনসমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল—(১) অসুর (২) মুণ্ডা (৩) সাঁওতাল (৪) হো বা লাড়কা কোল (৫) বিরহড় (৬) খাড়িয়া বা খেড়িয়া (৭) শবর (৮) কোরওয়া (৯) কোড়া বা কোড (১০) করকু (১১) করমালী বা কলহে (১২) মাহালি (১৩) ভূমিজ (১৪) গদব (১৫) তুরি (১৬) কুড়মি (১৭) যুয়াং। এইসব খেরওয়াল ভাষা গোষ্ঠী যখন আর্য আক্রমণে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল তখনই তারা আর্যদের “দিকু” বা বিদেশী আখ্যা দিয়েছিল বলে অনুমান হয়।”

আগে বলা হয়েছে, আর্য-অনার্যের বিশাল সংগ্রামে অনার্যরা পরাজিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, পরাজিত অনার্যরা কোথায় গেলেন? আর্যদের কাছে পরাজিত হয়ে অনার্যদের এক অংশ রাজপুতানার দিকে যায়, যার আভাস পাওয়া যায় James Tod - এর "Annals and Antiquities of Rajasthan" গ্রন্থে। অনার্য গোষ্ঠীর আর এক অংশ পূর্ব ভারতের দিকে, বলা যেতে পারে, গঙ্গা-যমুনার সমতল ভূমির দিকে এসেছিল, এর উল্লেখ পাওয়া যায "JOURNAL OF FRANCIS BUCHANAN" গ্রন্থে। আর্যরাও ক্রমশ পূর্ব ভারতের দিকে এগিয়ে এসেছিল। ব্রাহ্মণ রচনার যুগে অর্থাৎ ১৫০০ থেকে ৪০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে সরস্বতী নদী থেকে গঙ্গার দোয়াব পর্যন্ত সমতল খণ্ড দখল করে কুরু, কোশল, কাশী প্রভৃতি রাজ্য আর্যরা স্থাপন করেছিল। এ সবই ছিল আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, অনার্যরা পশ্চিমে লুনী নদী ও আরাবল্লী পর্বত ও পূর্ব দিকে ছোটনাগপুর মালভূমির দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। দক্ষিণে বুন্দেলখণ্ড, তাপ্তী ও মহানদীর সীমানা পর্যন্তও অনার্যরা ছড়িয়ে পড়েছিল। “হড়” নামকরণ প্রসঙ্গে জানা গেল, আর্যদের ঘৃণাসূচক নামকরণের প্রতিবাদে অনার্যরা নিজেদের “হড়” নামে পরিচয় দেয়। এ প্রসঙ্গে H. H. Resley তাঁর The People of India" গ্রন্থে লিখেছেন- "According to Mr. Skrebsrud the name Santal is a cooruption of Saontar and was adopted by the tribe after their Sojour for Several generations in the Country about saont they were said to have been called kharwar, the root of which, Khar is a variant of, hor, 'man' the name which all Santals use among themselves. আর্যরা যাদের দাস, দস্যু, অসুর ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছে রামায়ণের যুগে তাদেরই উল্লেখ করা হল 'বানর' নামে। রামায়ণে ‘বানর’ সৈন্যের ভূমিকার কথা আমরা জানি। আর্য লেখকগণ অনার্যদের যতই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখুক না কেন, অনার্যরাও বলশালী ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও পাণ্ডিত্য ছিল বলেই আর্য কবিকুল হনুমান, সুগ্রীব, বালীকে নিচু নজরে দেখতে পারেননি। একজন ঘৃণ্য ব্যক্তিকে যতই নীচু নজরে দেখি না কেন তার মধ্যে যদি সর্বসম্পন্ন গুণ থাকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব থেকেই যায়। রামায়ণেও তাই ঘটেছে। রামায়ণে নিষাদ' শব্দেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন—নিষাদ রাজ গুহক। রামায়ণে আর্য-অনার্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার চিত্র পাওয়া যায়। মনে হয়, দীর্ঘ সংগ্রামে ক্লান্ত আর্যরা শেষ পর্যন্ত অনার্যদের অস্বীকার করতে পারেনি বলেই পারস্পরিক হৃদ্যতার চিত্র এঁকেছেন। নামকরণে 'বানর' বা নিষাদ' যাই হোক না কেন নিজ ক্ষমতা গুণে অনার্যরা আর্য-সাহিত্যে শ্রদ্ধার আসন অধিকার করেছিল।

এবার আসা যাক মহাভারতের কথায়। মহাভারত মূলত রাজকাহিনী হলেও এর শিকড় রয়েছে অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে। মহাভারতের অন্ত্যজ শ্রেণী বা উপজাতি শ্রেণী, নিষাদ, রাক্ষস এরা আসলে অনার্যদেরই প্রতিভূ। রামায়ণের যুগে যেমন আর্য-অনার্যের পারস্পরিক সহযোগিতার চিত্র পাওয়া যায়, মহাভারতের যুগে আরও ঘনিষ্ট সম্পর্কের চিত্র পাওয়া যায়। এই সময়ে আর্য-অনার্যর মধ্যে রক্তের বন্ধন ঘটেছে। জেলেনীর রূপে মুগ্ধ আর্য রাজার কিংবা অন্ত্যজ শ্রেণীর কোনও রমণীর রূপে মুগ্ধ আর্য ঋষির মনোবিকলন ঘটেছে। পরিণামে ঘটেছে দৈহিক মিলন এবং পরিণামে ঘটেছে 


সৃষ্টি। এ তো রক্তের বন্ধন ছাড়া আর কিছু নয়। রাজা শান্তনু বিয়ে করে জেলেনীকে। ভীম বিয়ে করেন হিড়িম্বাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে অনার্যদের সঙ্গে এ সহাবস্থান ছাড়া আর্যদের কোন উপায় ছিল না। লক্ষ্যণীয়, এই সহাবস্থান বা বন্ধন ঘটেছে কেবলমাত্র অনার্য রমণীদের সঙ্গে। অনার্য পুরুষের সঙ্গে আর্য পুরুষের বন্ধুত্ব ঘটলেও আর্য রমণীরা কিন্তু অন্তঃপুরেই রয়ে গেছেন। সেখানে অনার্য পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। মহাভারতে অবিচারের চরম চিত্র পাওয়া যায়। 'একলব্য' প্রসঙ্গে যা অনেকেরই জানা। একলব্য তো অনার্য তথা খেরওয়াড় সমাজেরই প্রতিনিধি যার নামকরণ করা হল 'নিষাদ’। এই ভাবেই সমগ্র মহাভারতেও অনার্য তথা খেরওয়াড়দের পরিচিতি ছড়িয়ে আছে অন্ত্যজশ্রেণীর মধ্যে, নিষাদদের মধ্যে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ব ভারতে আর্যাবর্তের সীমানা ছিল মগধ পর্যন্ত। মগধের দক্ষিণে এবং পূর্বে যেহেতু আর্য অধিকার ছিল না স্বভাবতই এই সমস্ত অঞ্চ লে অনার্যদের বসতি ছিল। এই সমস্ত অঞ্চ লের অনার্যদের সম্বন্ধে এবার আলোচনা করা যাক। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বঙ্গ' নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে বঙ্গের অধিবাসীদের 'বয়াংসি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘বয়াংসি' অর্থে পক্ষী জাতীয় বিশেষ। জানা যায় এই বঙ্গ শব্দটি ছিল কোন কৌম গোষ্ঠীর নাম। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটি ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লিখিত বঙ্গ শব্দটি ভৌগোলিক অর্থাৎ স্থান সূচক হিসাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, ‘বঙ্গ’ স্থান সূচক শব্দটির সঙ্গে বৈদিক যুগের আর্যরা পরিচিত হবার আগে বঙ্গ কোন উপজাতির নাম ছিল, একথা অনেকেই বলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বঙ্গ নামক পূর্ব ভারতের এই অঞ্চ লে সর্বপ্রথম প্রোটো অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর বসতি ছিল, যাদের ভাষার নাম ছিল অস্ট্রিক। এই প্রবন্ধের শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে যে, খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা, তাহলে কি একথা বলা যায় না যে, আদি বাসিন্দা প্রোটো অস্ট্রালয়েড খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীরই পরবর্তী সময়ে 'বঙ্গ' নামে অভিহিত হত। অনেকেই বলেন, অস্ট্রিক শব্দ 'বঙ্গা' থেকেই 'বঙ্গ' শব্দের উৎপত্তি। 'বঙ্গা দিশম' অর্থে দেবতাদের স্থান অর্থাৎ ঈশ্বর ভাবনা প্রধান মানুষের স্থান থেকেই 'বঙ্গ' দেশের নামের আগমন বলে অনেকেই অনুমান করেন। এই অঞ্চ লের মানুষদের 'বয়াংসি' বা পক্ষী জাতীয় বলে আর্যরা বর্ণনা করেছেন। যদি ধরা হয়, এই অঞ্চ লের অধিবাসীদের ‘টোটেম’ হিসেবে পক্ষী বিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে তাহলে বলা যায়, এই 'বয়াংসি' বলতে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়েছে কেন না তাদের পুরাণ অনুযায়ী তাদের আদি পিতামাতা পিলচু হাড়াম-পিলচু বুড়হির জন্ম পাখী থেকে। আবার জানা যাচ্ছে, কোন আর্য বঙ্গ অঞ্চ লে ভ্রমণে এলে আর্য সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করত। বিভিন্ন যাগযজ্ঞের মাধ্যমে তাকে আবার আর্য সমাজে স্থান করে নিতে হত। বঙ্গের অধিবাসী এবং বয়াংসিদের প্রতি এমন ঘৃণা সূচক, তাচ্ছিল্যমূলক আচরণ থেকে আর্যদের বিদ্বেষেরই পরিচয় পাওয়া যায়। আর্যদের এমন বিদ্বেষ তো কেবলমাত্র অনার্য তথা খেরওয়াড়দের প্রতিই পাওয়া যায়। অন্ততঃ বৈদিক সাহিত্য থেকে তাই পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং একথা অবশ্যই বলা যায় ‘বয়াংসি' নামের মধ্যে খেরওয়াড়দের অস্তিত্বই লুকিয়ে রয়েছে।

আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আর্যাবর্তের পূর্ব প্রান্ত ঝাড়খণ্ডের দুর্ভেদ্য জঙ্গলখণ্ডে এসে থেমে যায়। তখন এই অরণ্যভূমিতে অনার্যদের বসতি ছিল। শ্রীঅশ্বিনীকুমার চৌধুরী তাঁর 'রাঢ়ভূমির সংস্কৃতি' গ্রন্থে লিখেছেন “জৈন আচরঙ্গ সূত্রে বর্ণিত আছে—লাঢ়াদিগের দেশে ভ্রমণকালে (খৃঃপূর্ব ষষ্ঠ শতক) মহাবীর নিজ ধর্মমত প্রচারে যথেষ্ট বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।” জানা যায়, জৈন ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে এই আরণ্য অঞ্চ লের লাঢ়ারা বা অনার্যরা মহাবীরের পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। সত্যিই ভাবা যায় না, ঐ সময়ে অনার্যরা কতখানি নিজস্ব ধর্ম সচেতন ছিল, প্রশ্ন উঠতে পারে কারা এরা? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আর্য-অনার্য সংগ্রামের সময় অনার্যরা ক্রমশ ভারতের পূর্ব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই অর্থে বিচার করলে রাঢ়ে অধিবাসী এই লাঢ়ারা খেরওয়াড় জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া জনগোষ্ঠী মাত্র। যারা খেরওয়াড় নামে পরিচিত। "JOURNAL OF FRANCIS BUCHANAN " গ্রন্থেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে—" appears to be that they come from still furture west." ডাঃ সুহৃদকুমার ভৌমিক তাঁর “আদিবাসীদের ভাষা ও বাঙলা” গ্রন্থের ‘প্রাচীন বঙ্গের আদিবাসী পরিচয়' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন—“ ঐতরেয় আরণ্যক

যার রচনাকাল আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব প্রথম বা খৃষ্টীয় প্রথম শতকে, সেখানে বলা হয়েছে যে, তিনটি জাতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা হল—বঙ্গ, মগধ ও চেরপাদ। এরা নাকি পক্ষী জাতির বংশধর।”

“প্রজা হি তিস্রঃ অত্যায়র্মীয়ুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজাতিঃ অত্যায়মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গাব গধাশ্চের পাদাঃ।”

এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেছেন, ঐ সময়ে বাঙালিরা কোল ভাষাগোষ্ঠীর লোক ছিল বলে সংস্কৃত জাত ভাষায় বা ইন্দোয়ুরোপীয় ভাষায় কথা বলত না। তাই সেই দুর্বোধ্য ভাষার মানুষকে তাঁরা কিচ মিচ করা পাখিই বলেছিলেন—তাই তারা বয়াংসি। কিন্তু তা নাও হতে পারে। বঙ্গ, মগধ এবং বর্তমান চেরোজাতি অধ্যুষিত চেরোপাদ অর্থাৎ সমগ্র পালামৌ অঞ্চল জুড়ে নিবিড়ভাবে বাস করত খেরওয়াল জাতিসমূহ 

অর্থাৎ কোল ভাষাগোষ্ঠীর সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো খেড়িয়া, খেরওয়াল, অসুর প্রভৃতি জাতি—যাঁরা তাঁদের পুরাণ অনুসারে মনে করেন, তাঁরা হলেন, খেরওয়াল। খের অর্থাৎ পাখির বংশধর। ঋষি ঐতরেয় মহিদাস বয়াংসি বা খেরওয়ালদের কথা ভোলেন নি। তার কারণ আর কিছু নয়, ঋষি মহিদাস ঋষিপুত্র হলেও তাঁর মা ছিলেন ইতর বা শূদ্র জাতীয়া রমণী সম্ভবতঃ কোল জাতির সঙ্গে ছিল তাঁর রক্তের সম্পর্ক।' সুতরাং দেখা যাচ্ছে, খেরওয়াল বা খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর পরিচয় ‘বয়াংসি’নামের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার “বাংলাদেশের ইতিহাস” গ্রন্থে লিখেছেন—

.প্রাচীনযুগে অন্ততঃ তিন হাজার বছর অথবা তাহারও পূর্বে যে বাংলাদেশের এই অঞ্চ লে সুসভ্য জাতি বাস করিত ইহা ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে......।” প্রশ্ন উঠতে পারে, যে সমস্ত সুসভ্য জাতি বঙ্গদেশে বসবাস করত তারা দল বেঁধে কোথায় চলে গেল? আসলে সেই সুসভ্য জাতিরই বিবর্তিত রূপ বর্তমানের বাঙালি। সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বঙ্গদেশে যে সমস্ত খেরওয়ার জনগোষ্ঠী ছিল তাদের এক অংশ আজ বাঙালি নামে পরিচিত আর বাকিরা পরিচিত আদিবাসী নামে। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খৃষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতক হল সম্রাট অশোক এবং কণিষ্কের কাল এবং খৃষ্টীয় চতুর্থ শতক গুপ্তযুগ থেকে শুরু করে সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্কের আমল ও পরবর্তী পাল রাজত্বের সময় পর্যন্ত খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না। এই বিশাল সময় সীমানায় তাদের কি নামে অভিহিত করা হত বা তাদের প্রতি উচ্চবর্ণের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল তা লিখিত আকারে না থাকায় জানা যাচ্ছে না। তবে, একথা ঠিক, নিজস্ব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবার পর বিশেষ করে আর্যরা সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় থেকেই খেরওয়াড়দের সম্পর্কে একটা হীন বা তাচ্ছিল্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা গেছে। সেই ধারাবাহিকতার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি এই বিশাল সময় সীমার মধ্যে ছিল তা কল্পনাও করা যায় না। পাল রাজত্বের শেষ দিকে দশম-একাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদে যে সমাজচিত্র ও দৈনন্দিন জীবনাচরণের চিত্র পাওয়া যায় তাতে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। তাই বলতে দ্বিধা নেই প্রাচীনকালের খেরওয়াড়দের পরিচয় পেতে গেলে চর্যাপদের উপর নির্ভর করতেই হয় যদিও পণ্ডিতগণ চর্যাদপদকে প্রাচীন বাঙালীর পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কথাটি আংশিক সত্য। তাছাড়া, বাঙালী তো খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ। চর্যাপদে যে শিকারের চিত্র পাওয়া যায়, মদ তৈরির চিত্র, মদ্য পানের চিত্র, পাহাড় জঙ্গল ঘেরা স্থানের চিত্র পাওয়া যায় তা কিন্তু খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র ও জীবনাচরণের চিত্রকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। 

১৯ সংখ্যক চর্যায় আছে—

“ভব নির্বাণে পড়হ মাদল মন পবন বেনি করণ্ডু-কসালা।”

অর্থাৎ ভব জগৎ নির্বাণের পথে মাদল বাজে। 

মন পবনকে করা হয়েছে করতাল

ও কাঁসর। চর্যাপদে ‘ডোম্বী' শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। 

১০ নং পদে আছে—

“তান্তি বিরুণ অ ডোম্বী আবরনা চাংগেড়া।

তোহর অন্তরে ছাড়ি নড় পেড়া।

তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী

তোহোর অন্তরে মো এ ঘেনিলি হাড়ের মালী।।

সরবর ভঙ্গি অ ডোম্বী খা আ মোলান ।

মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ।

অর্থাৎ আরে ডোম্বী তুই তাঁত বিক্রয় করিস চাঙ্গেড় বিক্রয় করিস তোর পাশে এসে আমি নাচের পোষাক ছেড়ে ফেলি, তুই তো ডোম্বী আর আমি হলাম কপালী। তোর জন্য পরেছি আমি গলায় হাড়ের মালা। সরোবর ভেঙ্গে কেমন তুই মৃণাল খাচ্ছিস, তোকে মেরে আমি তোর পরাণ নেব।

এই ‘ডোম্বী' শব্দটি ‘ডোম্ব’ থেকে আগত এবং ডোম জাতেরই উল্লেখ করা হয়েছে ‘ডোম্ব' শব্দের মাধ্যমে। চর্যাপদে ডোম জাতের উল্লেখ আছে ১০, ১৪, ১৮, ১৯ ও ৪৮ সংখ্যক পদে। Cultural Research Institute, Govt of West Bengal প্রকাশিত "Hand books on SC & ST of West Bengal by Das, Roy Chowdhury and Raha, 1966" গ্রন্থে বলা হয়েছে— The Doms are Sweepers in some places. They remove night soli and dead bodies. Some make baskets and mats. Bajania Doms are Musicians. Many Doms have taken to agriculture while many are landless, day-labourers." প্রাচীন যুগে এমনকি মধ্য যুগেও আজকের মত আদিবাসীদের বিচ্ছিন্ন জাতি হিসাবে দেখা হত না। আদিবাসীরা অবলীলাক্রমে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নস্তরে বিচিত্র কাজের ভার নিয়ে যোগ দিত। তারপর ধীরে ধীরে ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে পুরানো পরিচয় ফেলে হিন্দু সমাজের বিচিত্র শ্রমজীবী দলে বিলীন হয়ে যেত। সেই অর্থে ডোম জাতিও খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীরই অংশ বিশেষ। এই ডোমেদেরই রিজলি সাহেব নাম দিয়েছেন চণ্ডাল। Dr. Caldwell-এর ভাষায় এরা উত্তর ভারতের চণ্ডাল। Atkinson-এর মতে এরা এক সময় কুমায়ুন প্রদেশে ছিল তখন এরা ছিল ক্রীতদাস। সে যাই হোক না কেন, ডোমরা যে এক সময় পূর্ব ভারতে বসবাস করত তা বিভিন্ন স্থান নাম বিশ্লেষণ করলে জানা যায়। যেমন—ডোমরা গড়, ডোমডিহা ডোমকা বা দুমকা ইত্যাদি নামগুলি ডোমদের সঙ্গে যুক্ত। ডঃ সুহৃদ কুমার ভৌমিক জানাচ্ছেন—‘ডোমনাগড়ের দুর্গ ও 

তার পার্শ্বস্থ অঞ্চ লে এক সময় ডোমদেরই প্রাধান্য ছিল যদিও দুর্গের অধিপতিরা রাজপুত ক্ষত্রিয় বলে নিজেদের পরিচয় দিত। আসলে বহু স্থানের রাজা বা সামন্তরাজগণ জন্মসূত্রে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর হলেও বংশ মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিজেদের রাজপুত ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেয়।' ডোম বা ডোম্ব শব্দ খুব প্রাচীন নয়। কেন না, ষষ্ঠ শতকের আগে এমনকি অমর কোষের শূদ্রবর্গেও ডোম জাতির নাম পাওয়া যায় না। ‘ডমঃ' নামে একটা জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। মৎস্যসৃক্ত তন্ত্রের ৪৯ পটলে পাওয়া যায়—“চণ্ডালশ্বৈব ডোমশ্চ জ্ঞানকশ্চ – তথা ইতি............”। অনুমান করা যায়, ডাম্ব শব্দটি ডম্ ডম্ শব্দ থেকে এসেছে। এই শব্দের দ্বারা নাচ-গানের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং আমরা জানি খেরওয়াল জনগোষ্ঠী মানেই নাচ-গান প্রিয় । তাহলে কি বলা যায় না যে, ডোম্ব শব্দে খেরওয়াল জনগোষ্ঠীরই অংশ বিশেষকে বোঝানো হয়েছে। নৃ-বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ অবশ্য ডোমদের উৎস দ্রাবিড় আবার কেউ কেউ কোল গোষ্ঠীর বলেছেন। একথা ঠিক, কোন উপজাতি গোষ্ঠীর কোন দল যখন হিন্দু সমাজে আশ্রয় নিত, প্রাথমিকস্তরে তাদের ‘ডোম্ব’ নাম দেওয়া হত।

'হাড়ি' নামে আর একটা অন্ত্যজ শ্রেণীর নাম পাওয়া যায়। এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে পুজোর সময় যারা ঢাক-ঢোল বাজায় তারা ‘হাড়ি’ নামে পরিচিত। অনেকেরই ধারণা ‘হাড়ি' শব্দটি ‘হড়' শব্দ থেকে এসেছে। বলা হয় অত্যন্ত গরীব এবং যারা কাজে-কর্মে বিমুখ এই ধরণের ‘হড়’দের কোন কোন দল বাঁচার তাগিদে নিজস্ব সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে এই ঢাক-ঢোল বাজানোর মত সহজ জীবিকা গ্রহণ করেছিল। সুতরাং একথা অবশ্যই বলা যায়, ‘হাড়ি' সম্প্রদায় খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীরই এক বিশেষ অংশের নাম ।

আদি মধ্যযুগে খেরওয়াড়দের সম্পর্ক বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে, একথা বলা যায়, এই সময়ের মঙ্গলকাব্যগুলিতে এদের আভাস পাওয়া যেতে পারে। চণ্ডীমঙ্গলে ‘কালকেতু’ উপাখ্যানের কথা অনেকেই জানি। কালকেতু একজন ব্যাধ যুবক। কালকেতু ফুল্লরার দৈনন্দিন জীবন চিত্রও খেরওয়াড়দের জীবনচিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অনুমান করা যেতে পারে, ব্যাধ, নিষাদ নামের মধ্যে খেরওয়াড়দের পরিচয় লুকিয়ে রয়েছে। যদিও মঙ্গলকাব্য রচয়িতাগণ গ্রামীণ বাঙালী সমাজের চিত্র অঙ্কনের কথাকেই বুঝিয়েছেন।

পঞ্চ দশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত 'ভবিষ্যৎ পুরাণে' রাঢ়খণ্ড বা ঝাড়খণ্ডের খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীকে বন্য, ধর্মহীন, সর্প খাদক এবং শিকার ও লুন্ঠনই এদের জীবিকা হিসাবে বলা হয়েছে। খেরওয়াড় তথা অনার্যদের প্রতি আর্যরা যে হীন দৃষ্টির সৃষ্টি করে গেছেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গি ষোড়শ শতাব্দী কেন আজও তা উচ্চ সমাজে প্রবাহিত। ষোড়শ শতাব্দীর আলোচনায় মহাপ্রভুর প্রসঙ্গ এসেই যায়। নীলাচল থেকে বৃন্দাবন যাত্রাকালে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ঝারিখণ্ডের বনপথ ব্যবহার করেছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের “চৈতন্য চরিতামৃত” থেকে জানা যায়—

মথুরা যাবার ছিল আসি ঝারিখণ্ড।

তিনি জী ভিন্ন প্রায় লোক তাহা পরম পাষণ্ড ।।”

দেখা যাচ্ছে, ঝারিখণ্ড অঞ্চ লের আদিম অধিবাসীদের “পাষণ্ড” বলা হয়েছে। ঝারিখণ্ডের আদিম অধিবাসীরা যে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর লোক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চৈতন্যদেব যখন ঝারিখণ্ড' বা ‘ঝাড়খণ্ড’ অঞ্চ লে প্রেম ধর্ম প্রচার করেন তখন বৈষ্ণব ধর্ম প্রসারের ফল দ্রুত দেখা গেল। হরি নাম নিয়ে দলকে দল আদিবাসী বিচিত্রভাবে হিন্দু সমাজের অঙ্গ হয়ে গেল। অবশ্য এও জানা যায়, অস্ট্রিকদের মধ্যে যারা এই বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের ‘ভগত' বলা হয়েছে। TA ET সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদিবাসী ও অন্যান্য বিচিত্র সম্প্রদায়ের একটা তালিকা পাওয়া যায়। তা এরকম— (১) কিরাত (২) কেশুর (৩) কোঁচ (৪) কোরাঙ্গা (৫) কোল (৬) গোয়ালা (৭) চণ্ডাল (৮) চামার (৯) চুনারি (১০) চোদুল (১১) ছুতার (১২) ডোম (১৩) দরজী (১৪) দাস (১৫) ধাজি (১৬) ধোপা (১৭) ধোয়ারা (১৮) পাইক (১৯) পাটনি (২০) পানই (২১) পুলিন্দ (২২) বাইতি (২৩) বাগদি (২৪) বেরুনিয়া (২৫) বেহারা (২৬) ভাট (২৭) মাছুয়া (২৮) মাঝি (২৯) মারহাটা (৩০) মাল (৩১) শুঁড়ি (৩২) শালঙ্কী (৩৩) শিউলি (৩৪) হাড়ি। সহজেই অনুমেয়, পেশাগত কারণে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর অংশ বিশেষকে এইভাবে বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়গত নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, "A Hand Book of Criminal Classes” নাম দিয়ে যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তার প্রায় সবাই আদিবাসী তথা খেরওয়াড় এবং তপশিলী সম্প্রদায়ের।

মিলা ভারতের বুকে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে বিশাল সংখ্যক খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল এইভাবে কালক্রমে হিন্দু সমাজের অঙ্গ হয়ে যাওয়ায় খেরওয়াড়দের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে নির্দিষ্ট সীমারেখায় এসে দাঁড়িয়েছে।

জানা যায় মুসলমান ঐতিহাসিকগণ পূর্ব ভারতের আদিম অধিবাসীদের তথা খেরওয়াড়দের “চের” নামে অভিহিত করলেও ইংরেজ আমলের আগে “আদিবাসী” শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় না। ইংরেজী Tribe শব্দের ভারতীয়করণ করা হয়েছে— আদিম জাতি, বন্যজাতি, বনবাসী, বনচারী, আদিবাসী, জনজাতি, উপজাতি প্রভৃতি। বাংলায় আদিবাসী, উপজাতি ও হিন্দীতে জনজাতি শব্দের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা 

যায়। সরকারী কাগজপত্রে এদের বলা হয়েছে “শিডিউলড ট্রাইব। ট্রাইব-এর উপজাতি এবং Scheduled Tribe অর্থে সেই সব উপজাতিকে বলা হয় যাদের সরকারীভাবে শিডিউলড অর্থাৎ অনুসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানকার আদিম অধিবাসীদের উপর 'ট্রাইব' এর ছাপ লাগানো হল কেন? উত্তরে বলা যায়, যখন দেশে জনগণনার কাজ শুরু হয় তখন হিন্দুদের সম্পর্কে লেখা হত তাদের মধ্যে কে কোন জাতির, তার কথা। কিন্তু আদিবাসীরা তো এদের কাছে কোন জাতি নন ফলে তাঁদের ক্ষেত্রে কি লেখা হবে? তাদের নাম দেওয়া হল 'ট্রাইব'। এটাও ভারতীয় চিন্তাভাবনা থেকে পৃথক ছিল। অনেক আদিবাসী জাতিবাদ মানেন না কিন্তু নিজেদের হিন্দু বলেন। কিন্তু ইংরেজ সরকার জাতিবাদ মানেন না এমন হিন্দুদের হিন্দু বলতে স্বীকার করলেন না । বললেন, এরা হল ট্রাইব। আদিবাসীদের অনার্যদের বংশধর বলার সাথে সাথে এদের অনগ্রসরও বলা হল। যে জাতি বর্ণ মানে না তাকে না কেবল ট্রাইব বলা হল বরং এর অর্থও ঋণাত্মক করা হল যে, এরা হল নিচুস্তরের মানুষ। জাতিবাদী সিদ্ধান্তের সাহায্যে অনার্যের ইতিহাস এবং ট্রাইব-এর রূপে পরিচিতি দুটোর মধ্যে মেল বন্ধন ঘটানো হল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর যখন Scheduled Tribe-এর তালিকা তৈরী হল তখন স্রেফ সেই ধরনের কিছু জাতি সম্প্রদায়কে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হল যাদের অনগ্রসর বলে স্বীকার করা হয় অর্থাৎ এটা স্বীকার করা হয় যে, ওদের উপরে তোলবার জন্য অন্যদের সাহায্য প্রয়োজন। সত্যি কথা বলতে কি, অবিচারের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল। বৈজ্ঞানিকেরা সম্পূর্ণ উল্টো দিক দিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলেন। ঐতিহাসিকরা দেখলেন না যে, অনার্যদের বংশধর কারা হতে পারেন। বরং ওঁদের কাজ হল Scheduled Tribe-দের অনার্যদের বংশধর প্রমাণিত করা। এতে কালো দ্রাবিড় লোকেরা বাদ পড়ে গেল। শুধু Scheduled Tribe -রাই হলেন আদিবাসী। সমাজ বিজ্ঞানীরা দেখাতে লাগলেন যে এরা অসভ্য তাই এরা হিন্দু হতে পারে না। নৃতত্ত্ববিদরা এই কথাটি প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, Scheduled Tribe লোকেদের বুদ্ধি কম, এদের আচার ব্যবহার সভ্যতাবর্জিত ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব স্বাধীন ভারতের ‘দিকু’ সরকার যা কিছু বলেন তাই ঠিক। এদের উপরে টেনে তোলাটা ওঁদের মানবিক দায়িত্ব।

ইংরেজ আমলে আদিবাসীদের বিশেষত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পুরুষদের ‘মাঝি’ এবং মহিলাদের ‘মেঝেন' বলা হত। সেই ধারাবাহিকতার উদাহরণ হিসেবে এখনও অনেক সাঁওতালদের পদবী রয়েছে 'মাঝি'। আসলে স্বাধীন ভারতবর্ষেও আদিম অধিবাসীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি তাই অদ্ভুত, অস্পৃশ্য বলে এদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকেও সাঁওতালী ভাষাকে অ-আদিবাসীরা তাচ্ছিল্য ও ঘৃণাসূচক ঠার' বলত। ‘ঠার' অর্থে পশুপাখীর ভাষা। নিজস্ব জাতিসত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন আদিবাসীরা 'দিকু’দের অবিচার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলেন না। ১৯৩৮ সালে গঠন করা হল আদিবাসী মহাসভা। শুরু হয় আপন অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৫০ সালে জন্ম নেয় ঝাড়খণ্ড পার্টি। ঝাড়খণ্ড পার্টি রাজনৈতিক দল হলেও আদিবাসীরা এরই মধ্যে আপন জাতিসত্ত্বাকে অনুভব করলেন। ঝাড়খণ্ড পার্টি আদিবাসীদের জন্য পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের দাবী পেশ করে। লড়াই শুরু হয়। ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। মূলতঃ ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সূত্র থেকেই ‘ঝাড়খণ্ড' শব্দ ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ঝাড়খণ্ডী অর্থে ঝাড়খণ্ড অঞ্চ লের আদিম অধিবাসী তথা আদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত জনগণকেই বোঝানো হয়। এতে ভারতের আদিবাসী নামে দুটো ভাগের সৃষ্টি হয়। ঝাড়খণ্ড অঞ্চ লের আদিবাসী তথা ঝাড়খণ্ডীরা এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চ লের আদিবাসী। যদিও আদিবাসীদের মধ্যে অঞ্চলভিত্তিক নাম আছে। যাইহোক, পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ নব্বই-এর দশকে আদিবাসীদের দুটো নামে চিহ্নিত করা হল। এক, বনবাসী। জানা যায়, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে রাজধানী দিল্লীতে পক্ষকালব্যাপী 'বনবাসী উৎসব' পালিত হয়। দুই, অনগ্রসর সম্প্রদায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন 'উপজাতি কল্যাণ বিভাগ' নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অনগ্রসর কল্যাণ বিভাগ'।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন হওয়ায় 'ঝাড়খণ্ডী' শব্দটি পাকাপাকি আসন গ্রহণ করে। ইদানীং আদিবাসী শব্দের পরিবর্তে আদিবাসীদের বোঝাতে ‘ঝাড়খণ্ডী’ শব্দেরই ব্যাপক ব্যবহার শোনা যায় ।

সুতরাং দেখা গেল, খেরওয়াড় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত হয়ে কালক্রমে ‘ঝাড়খণ্ডী' হয়েছে। খেরওয়াড় থেকে ঝাড়খণ্ডী ৷৷


0 Reviews