লো কা য় ত সংস্কৃতি রাঢ়ের স্মৃতি: এড়োয়ালীর কালীপূজা

লো কা য় ত সংস্কৃতি রাঢ়ের স্মৃতি: এড়োয়ালীর কালীপূজা

Size

Read more

 লো কা য় ত সংস্কৃতি রাঢ়ের স্মৃতি: এড়োয়ালীর কালীপূজা

হরি আর ভরতের দেহের হিজলে জোয়ানের রক্ত আসন্ন বিপদের মুখে বহুদিন পরে আজ আবার তাদের লড়াইয়ের ডাক পাঠিয়েছে। দু-কান ভরে আজ বুঝি তারা আবার সেই ডাকাতে হাঁকাড় শুনছে—'আ...ব্বা... বা...বা...বা...।' গাড়োয়ালি তাদের পেশা নয়। বাবুদের বাড়ির বৌ-বিটিরা কোথাও গেলে তারা গাড়ি ডাকাত (চালাত) শুধুমাত্র নিমকের ঋণ, বাবুদের খাতির আর তাদের মা-বুনেদের নিরাপত্তার জন্য।

মোষের গাড়ি-দুটো পাকা সড়ক ছেড়ে ডাইনে কাঁদরের দিকে নামল। সওয়ারিদের কথা বলা বা কোনো শব্দ করা বারণ। চালকদের মুখেও গাড়ি ডাকানোর পরিচিত হাঁকডাক নেই। সুশিক্ষিত মোষগুলো তাদের মালিকের হাতের মৃদু ছোঁয়ায় পথ বুঝে নিচ্ছে। কাঁদরের বুকে জমে ওঠা হালকা কুয়াশা আর জোছনা মিলেমিশে সূক্ষ্ম পরদার মতো একধরনের আড়াল তৈরি করেছে। কিছুটা দূর পর্যন্ত দৃশ্যমানতা থাকলেও সড়ান দেখা যায় না। হয়তো সড়ান থেকেও আমাদের দেখা যাচ্ছে না। সেই আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে আমাদের গাড়ি-দুটো সাধ্যমতো নিঃশব্দে কাঁদরের ভিতর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ নেই বললেই চলে। জল ক্রমেই গভীর হচ্ছে, একসময়ে তা খড়ের গদি ছুঁয়ে ফেলল।

হঠাৎই কিছুদূরে কাদরের বুকে একটা বিরাট আগুনের গোলা দপ করে জ্বলে উঠেই দুরন্ত গতিতে কিছুদূর ছুটে গিয়ে নিভে গেল। বৃদ্ধাদের মধ্যে কে যেন দারুণ ত্রাসে ফিসফিস করে কোনোমতে বলে উঠলেন—‘পেত্যা'।

শুধু বিড়বিড় করে রামনাম জপ করার শব্দ ছাড়া দুই গাড়িতেই দমচাপা স্তব্ধতা। মাথার ওপর

দিয়ে একটা বড় পাখি, সম্ভবত পেঁচা 'শ্যা শ্যাঁ' করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। কাদরের মধ্যে যে ছোট ছোট দ্বীপগুলো আছে, তার কোনোটা থেকে শকুনছানা অবিকল কচি ছেলের মতো ককিয়ে কেঁদে উঠল। একটু পরেই কিছু দূরে আবার সেই আগুনের গোলাটা জ্বলে উঠল। তারপর আবার, আবারও। শুধু ভরসার কথা এই যে, সেটা আমাদের দিকে না এসে ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল।

সেই আমার প্রথম আলেয়া দেখা। আমাদের দেশ অঞ্চলের মানুষজন আলেয়াকে বলে 'পেত্যা', যা সম্ভবত প্রেতাত্মার অপভ্রংশ। তখন অবশ্য জানতাম না যে, জলাভূমিতে পচা উদ্ভিদ থেকে তৈরি হওয়া ‘মার্শগ্যাস’ই বিশেষ কিছু অবস্থায় হঠাৎ জ্বলে উঠে আলেয়ার সৃষ্টি করে। পরবর্তিকালে আরো দু-একবার আলেয়া দেখলেও প্রথম দেখার সেই ভয়ংকর স্মৃতি কোনোদিনই ভুলতে পারব না।

সেই রাতে সড়ানে ডাকাতরা ছিল কি না জানি না, তবে কালু ঘোষের নাতিদের কল্যাণে তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি এবং সূর্য ওঠার কিছু পরে নিরাপদেই আমরা দুইলে পৌঁছেছিলাম। সালিন্দের তিন বৃদ্ধা কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে একটা গাড়িতে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। আর আমরা অন্য গাড়িটায় কান্দি পৌঁছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিয়ে পড়ন্ত দুপুরে এড়োল পৌঁছেছিলাম।

কালীতলার খ্যাতি দুটি কারণে। প্রথমত, এখানকার এক বিরাট অঞ্চলের মানুষের কাছে দোহালিয়া কালীকে সবাই খুব জাগ্রত মনে করে। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, কালীবাড়ি থেকে চোখের বিভিন্ন রোগের ‘অব্যর্থ' ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে যারা আগ্রহী তাদের কাছে দোহালিয়ার অন্য গুরুত্ব আছে।

কান্দির কাছে দোহালিয়া গ্রামের দক্ষিণাকালীর থান সিদ্ধপীঠ বলে খ্যাত। অনেকেই অনুমান করে, কোনো এককালে মন্দিরের দক্ষিণদিক দিয়ে ময়ূরাক্ষী বয়ে যেত। গ্রামের আশপাশে রসড়া, বহড়া, মাড্ডা, সোলাপাড়া, হাপিনে প্রভৃতি দহগুলো ময়ূরাক্ষীর প্রাচীন খারার স্মৃতিচিহ্ন বহন করত। জনশ্রুতি হলো, মঙ্গলকাব্যের চাঁদ সদাগর, ধনপতি সদাগরেরা ময়ূরাক্ষীর স্রোতে ডিঙা ভাসিয়ে বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময়ে এখানে বিশ্রাম নিতেন। মন্দিরের কাছেই ধনডাঙায় যে প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ দেখা যেত সেটা নাকি ধনপতি সদাগরের বিশ্রামগৃহ ছিল। ধনপতির নামে জায়গার নাম ‘ধনডাঙা”। দোহালিয়ার পশ্চিমে নবদুর্গা গোলহাট গ্রামে ধনপতির নাকি আরেকটা বাড়ি ছিল।

শোনা যায়, লক্ষ্মণ সেনের আমলে কান্দির খুবই কাছে ছাতনেকান্দির করাতিয়া ব্যাস সিংহের ছেলে বনমালী সিংহ বিখ্যাত বৈষ্ণৱ পণ্ডিত ছিলেন। বনমালীর গুণমুগ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন তাঁকে জেমো, কান্দি প্রভৃতি অঞ্চল দান করেন। সেসময়ে এই এলাকা ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল এবং জেমো, কান্দি, বাঘডাঙা প্রভৃতি নামের কোনো গ্রামই ছিল না। বনমালীই জঙ্গল কেটে এখানে প্রজা বসান বলে লোকে তাঁকে ‘বনকাটী সিংহ' বলত। পরম বৈষ্ণব বনমালী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কিরীটেশ্বরীর কোনো তান্ত্রিক সাধকের কাছে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। তিনিই দোহালিয়ায় একটা ছোট কালীমন্দির স্থাপন করেন এবং পুরোহিত, বাজনদার, ঝাড়ুদার, কুমোর, চাষি প্রভৃতি বিভিন্ন বৃত্তির মানুষকে দেবোত্তর সম্পত্তি দিয়ে (মতান্তরে পুরোহিত ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে চাকরান জমি) বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। পরে অবশ্য ১৩০৪ বঙ্গাব্দে (১৮৯৭ সালে) সেই মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির গড়া হয়।

তবে, বনমালী সিংহের মন্দিরপ্রতিষ্ঠার কয়েকশো বছর আগে থেকেই বহু কৌলাচারী তান্ত্রিক, কাপালিক সাধকেরা এখানে জঙ্গলের মধ্যে পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে গোপনে শবসাধনা ইত্যাদি করতেন। এককালে মন্দিরের আশপাশে অনেকগুলি গুপ্ত সিদ্ধাসন ছিল এবং এখানে নরবলিও হতো বলে জানা যায়।

* বনমালী সিংহ মন্দির স্থাপন করলেও দোহালিয়ার নাগার্জুন)। বশিষ্ঠ (বা সিদ্ধ নাগার্জুন) ছিলেন সপ্তম আদি প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় বশিষ্ঠদেবকে (মতান্তরে শতাব্দীর মানুষ। সুতরাং দোহালিয়ার ইতিহাসের শুরু সিদ্ধপীঠটি জনসমক্ষে আসে দ্বাদশ শতাব্দীতে। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে—যদিও এই বিভিন্ন বৌদ্ধ ও তন্ত্র গ্রন্থে বশিষ্ঠদেবকে অত্যন্ত উচ্চকোটির সাধক বলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কামাখ্যায় তন্ত্রসাধনা করেও সিদ্ধিলাভ না হওয়ায় বৃহস্পতির বরপুত্র বশিষ্ঠদেব কামাখ্যাদেবীর (মতান্তরে বুদ্ধের) আদেশে তিব্বতে চলে যান। সেখানে বৌদ্ধতন্ত্র বা চীনাচারের অন্তর্গত 'তারা' সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। এরপর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি মহাচীন থেকে ‘তারা’কে নিয়ে প্রথমে কিরীটকোণা বা কিরীটেশ্বরীতে, তারপর দোহালিয়ায় আসেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পরে তিনি তারাপীঠে গিয়ে থিতু হন। দোহালিয়ার মূল কালীমূর্তিকে অনেকেই বৌদ্ধ ব্যাঘ্রমূর্তি মনে করে। যেমন কিরীটেশ্বরীর ভৈরবও আসলে ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি। মুর্শিদাবাদ-বীরভূমে তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে বৌদ্ধতন্ত্র তথা মহাযানী ঐতিহ্য অস্বীকার করা কঠিন।

ক্ষেত্রেও মুর্শিদাবাদের লৌকিক ধর্মাচরণের বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাব দেখা যায়। কান্দির জেমো বাঘডাঙার বিখ্যাত রুদ্রদেবও ভূমিস্পর্শ মুদ্রার বুদ্ধমূর্তি। প্রায় দেড় ফুট উঁচু কালো পাথরে খোদাই করা বুদ্ধমূর্তির ডানহাত নাভিমূলে এবং বামহাত ভূমি স্পর্শ করে আছে। বুদ্ধ প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর সমাধিমগ্ন হয়ে বসে আছেন, পাশে বোধিসত্ত্বগণ ও দেবতারা এবং পদ্মাসনের নিচে আছেন উপাসকেরা, ওপরে পালঙ্কে মহাপরিনির্বাণোন্মুখ বুদ্ধ শয্যায় শায়িত।

খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় চোদ্দ শতকের শেষে বা পনেরো শতকের শুরুতে কান্দির সিংহবংশীয় রাজাদের ত্রয়োদশ পুরুষ রাজা লক্ষ্মীধর সিংহের ছেলে রুদ্রসিংহ রুদ্রদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক নবম বা দশম শতাব্দীতে তৈরি মূল মূর্তিটি ১৯৬১ সালের ১৫ অগস্ট চুরি হয়ে যায়। পরের বছর এপ্রিল মাসে আসল মূর্তির একটা হুবহু নকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখনো নাকি রুদ্রদেবতলায় বন্ধ্যাত্ব ও কুকুরে কামড়ানোর ওষুধ দেওয়া হয়।

কান্দির সিংহরাজারা রুদ্রদেবের প্রতিষ্ঠাতা হলেও রুদ্রদেব কিন্তু আদিতে গোয়ালা, পরামানিক, চণ্ডাল, বাগদি, জেলে প্রভৃতি তথাকথিত নিচুজাতের মানুষদের দেবতা। রুদ্রদেবের ওপর তাদেরই দাবি বেশি। তারাই রুদ্রদেবের মধ্যে ধর্মরাজকে মিশিয়ে দিয়েছে এবং আধার হিসাবে খুঁজে নিয়েছে মহাযানী বুদ্ধমূর্তিকে। সম্ভবত রুদ্রদেবরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই সমাজের নিচুতলার মানুষজন এই বুদ্ধমূর্তিটিকে ধর্মরাজজ্ঞানে পুজো করত।

এখনকার কথা সঠিক বলতে পারব না, তবে বিগত পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেও গাজনের সময় আটাশে চৈত্র সন্ধ্যায় কোনো চণ্ডাল ভক্ত ('জলকুমুড়ী' ভক্ত) মন্দিরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তিনঘণ্টা একাকী রুদ্রদেবের পুজো করত। বিগত আশির দশকেও রাজবংশীরা না এলে মন্দিরের দরজা খুলত না এবং বলির পাঁঠাটি তারাই পেত। চৈত্র সংক্রান্তির আগের রাতে নিচুজাতের নানা গোষ্ঠী রুদ্রদেবের মন্দিরের উঠানে ‘মুখোশনাচ' নাচত। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। গোটা মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়েই বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধতন্ত্রের অসংখ্য নমুনা ছড়িয়ে আছে। বিশেষত সপ্তম শতাব্দীর রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধ মহাবিহার আর পাঁচথুপির কথা তো অনেকেই জানেন। শোনা যায়, 'পাঁচথুপি' নামকরণই হয়েছিল পাঁচটি বৌদ্ধস্তূপের উপস্থিতির কারণে।

আগেই বলেছি, বিগত ছয়ের দশকে কোনোদিক থেকেই সরাসরি এড়োল যাওয়ার বাস মিলত না। রামপুরহাট থেকে এড়োল যাওয়ার পথ তো তখনো সম্পূর্ণ হয়নি। সুতরাং কুলীতে বাস বদল করে খড়গ্রামে গিয়ে নামতে হতো। সেই বাসেও আবার 'ফাস ক্লোস', 'সেকেন কেলাস' ছিল। ফার্স্ট ক্লাস ছিল ড্রাইভারের কেবিনের ঠিক পিছনেই—রেলিং দিয়ে ঘেরা একসারি আসন, যার ভাড়া একটু বেশি। ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়েই বাক্স-বেডিং বাসের ছাদে তুলে দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসে জায়গা পাওয়া যেত। আর সেকেন্ড ক্লাস মানে ভিড়ে গাদাগাদি করে আমজনতার সঙ্গে যাওয়া। সেই ভিড়ের মধ্যে কোনো কোনো চড়নদারের হাতঝোলা থেকে মুখ বাড়ানো এক-আধটা ছাগলছানা বা হাঁস-মুরগিও নেহাত অমিল ছিল না। সেজন্য রাগ- গোঁসার প্রশ্নই উঠত না। দিনের মধ্যে হাতে গোনা ক-খানা বাস, তাও আবার প্রায়ই সময়মতো আসত না। আর সব জায়গাই পায়ে হাঁটা দূরত্বে হলে কী আর লোকে গাঁটের কড়ি খরচ করে বাসে চড়ে। তার পরে রোদ-বৃষ্টি আর ঝড়-বাদলও তো আছে নাকি। তাহলেই বলুন, লোকে ঐসব ‘কেষ্টর জীব’কে নিয়েই বাসে চড়বে না তো কী সাধের পোষ্যগুলোকে পরের ভোগে লাগার জন্য পথে ছেড়ে দিয়ে যাবে?

তা সেই সবকিছু নিয়েই লজঝড়ে বাস তার হাড়- পাঁজরায় নানান কিসিমের আওয়াজ তুলে কোঁকাতে কোঁকাতে যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধু ধু মাঠের বুকে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বাদশাহি সড়ক ধরে ধুলো উড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াত।

শোনা যায় কোনো এককালে বাদশাহি সড়কের বিস্তার ছিল গৌড় থেকে কালনা হয়ে পুরী পর্যন্ত। তবে সব জায়গায় এখন আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কারণ আর কিছুই নয়, নগরায়ণের প্রয়োজনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিভিন্ন অঞ্চলে বাদশাহি সড়ককে বদলে দিয়েছে স্টেট বা ন্যাশনাল হাইওয়েতে। সেখানে তার পরিচয় নাম দিয়ে নয়, নম্বর দিয়ে। সে যাই হোক, বাদশাহি সড়কের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ইতিহাস আর কিংবদন্তি।

অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক ফকিরের দেখা পান। কোনো এক বাদশা নাকি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে দয়া করে সেই বাদশা বা ফকিরের নাম জিগাবেন না। কারণ, এসব গল্পে নাম-ঠিকানা বলার কারো কোনো দায় থাকে না। সবটাই হলো 'এক যে ছিল রাজা'র কাহানি। তা, সেই ফকিরের কাছে বাদশা জানতে পারেন, রাজধানীতে পৌঁছেই তাঁর মৃত্যু হবে। বাদশার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। আকুল হয়ে তিনি ফকিরকে ধরে বসলেন- যাহোক কিছু একটা উপায় তাঁকে বাতলাতেই হবে। ফকির বললেন–ললাটের লিখন তো আর বদলানো যাবে না, বাদশার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তবে তাঁর মৃত্যুকে বেশ কিছুদিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে।

বাদশা তখন ফকিরের সব কথাতেই রাজি। ফকির তাঁকে বলেন: আপনি রাজধানী পর্যন্ত একটা চওড়া সড়ক তৈরি করুন। পথের দু-পাশে গাছ লাগান, ‘ডাক অন্তর মসজিদ' বানান আর 'ক্রোশ অন্তর দিঘি' কাটানোর আদেশ দিন। ‘ডাক অন্তর মসজিদ'-এর অর্থ হলো- একটা মসজিদের আজানের ধ্বনি যেখানে পৌঁছে ক্ষীণ হয়ে আসবে, সেখানে হবে আরেকটা মসজিদ। এইভাবে একের পর এক মসজিদ তৈরি হবে এই সড়ক বরাবর। তাতে যেমন সকাল-সাঁঝে এই মুলুকে আল্লার নাম ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে, তেমনি এই পথের পথিকেরা কখনো রোদে আর তেষ্টায় কষ্ট পাবে না। তাছাড়াও এর ফলে গ্রীষ্মে এক বিশাল অঞ্চলের মানুষের জলকষ্ট কিছুটা লাঘব হবে, সেইসঙ্গে চাষেরও উন্নতি ঘটবে। বাদশা এই পথ তৈরি করে তবে রাজধানীতে পা রাখবেন। ফলে এই বিরাট কর্মযজ্ঞের জন্য যে বেশ কয়বছর সময় লাগবে ততদিন বাদশাও বেঁচে থাকবেন।

এইভাবেই তৈরি হয় বাদশাহি সড়ক এবং তার ধারে ধারে প্রচুর মসজিদ ও দিঘি। তার মধ্যে কিছু দিঘি তাদের উঁচু পাড়ে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে আজও টিকে আছে।

কোনো সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে না পৌঁছালেও অনেকেই মনে করে, বাদশাহি সড়কের নির্মাতা ছিলেন গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ এবং পরবর্তিকালে শের শাহ এই পথ সংস্কার করেন। সম্ভবত ১৫১৫ সালের শেষদিকে হোসেন শাহ তাঁর শেষ ওড়িশা-যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে এই কাজ শুরু করেন। সেই হিসাবে এই পথের বয়স হলো পাঁচশো বছর। এখনো বর্ধমান জেলার নতুনহাটে (মঙ্গলকোট থানা) একটা বিশাল দিঘির পাড়ে হোসেন শাহের তৈরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। দিঘিটির অবশ্য অনেকটাই বুজিয়ে জনবসতি হয়েছে। নতুনহাট থেকে ভাতার থানায় ঢুকে বর্ধমানের দিকে তিন সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে আরো একটা দিঘি ও মসজিদের ধ্বংসস্তূপ আছে। এই দুটো জায়গাই বাদশাহি সড়কের পাশে। তেমনি মুর্শিদাবাদ জেলায় বাদশাহি সড়কের পাশে দেখা যায় আখড়াইয়ের দিঘি। সত্যি-মিথ্যে জানি না, লোকমুখে এমন কথাও শোনা যায় যে, কান্দির কাছে মণিগ্রামের পাশে এক আনি চাঁদপাড়ায় হোসেন শাহের জন্ম হয়েছিল এবং তাঁর প্রথম জীবনটা নাকি সেখানেই কেটেছিল।

পথে বাদশাহি সড়কের ডানদিকে বাবলা বনে ঢাকা কুলী থেকে খড়গ্রামের দূরত্ব ছয়-সাত কিলোমিটার এলিয়ে পড়ে থাকত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সুবিশাল পাহাড়প্রমাণ উঁচু পাড়ের মাথায় ভাঙা মসজিদ নিয়ে গা আখড়াইয়ের দিঘি। এই অঞ্চলে একটা ত্র্যহস্পর্শ যোগের কথা মুখে মুখে চালু ছিল—'আখড়াইয়ের দিঘির মাটি, বাহাদুরপুরের লাঠি, কুলীর ঘাঁটি'। খড়গ্রামের কাছেই বাহাদুরপুর ছিল বিখ্যাত লাঠিয়ালদের গ্রাম।

বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালরা ছিল জাতে বাগদি। তাদের সমাজে লাঠিবাজিতে যে যত দড় তার তত সম্মান ছিল। এরা শুধুমাত্র লাঠির জোর আর বুকের পাটায় অর্থাৎ হিম্মতে বিশ্বাস করত। বছর পঞ্চাশ-ষাট আগেও তাদের নিয়ম ছিল–বিয়ে করতে এসে বর ও পাত্রপক্ষকে কন্যাপক্ষের 'ঘাঁটি' ভেঙে কনেকে বিয়ে করতে হবে। তার নাম ছিল 'ঘাঁটিখেলা'। ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতেরা যেভাবে লাঠি খেলে গেরস্ত এবং বাইরের লোকদের আটকে রাখত, তারই অনুকরণে এই ঘাঁটিখেলা। কন্যাপক্ষ ঘাটি গেড়ে পাত্রপক্ষকে আটকে দিয়ে তাদের হিম্মত যাচাই করতে চাইত। ঘাঁটি ভাঙতে না পারলে তা হতো বর ও বরপক্ষের কাছে দারুণ লজ্জার বিষয়, যার থেকে মনে হয়—কোনো এককালে সম্ভবত এদের কন্যারা বীর্যশুল্কা ছিল। ঘাঁটিখেলাকে কেন্দ্র করে সত্যিকারের লাঠির লড়াইও যে কখনো হতো না—এমন নয়।

বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালরা নবাবের ফৌজে এই কাজ করত। ইংরেজ আমলে নবাবি পল্টনের কাজ যাওয়ার পরে এরা বিভিন্ন জমিদার ও ধনীদের কাছে 'লেঠেল বা লাঠিয়াল হিসাবে আশ্রয় পায়। এরা ইংরেজ সরকারের দেশি বাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল না, নাকি প্রশাসনই এই বুনো ঘোড়াদের পোষ মানাতে ভয় পেয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে একথা সত্যি, ব্রিটিশ সরকারের দেশি সেপাইদের মধ্যে এদের দেখা যায়নি। ইংরেজ রাজত্বে ম্যাজিস্ট্রেট থানা-পুলিশের প্রতাপে ক্রমশ এই জমিদার ও ধনীদের দাপট কমতে শুরু করে। ফলে এই লেঠেলদেরও চাকরি যাওয়া শুরু হয়, আবারও তাদের তাতে টান পড়ে।

বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালরা চাষের কাজকে ঘেন্না করত। তারা মনে করত—মাটির সঙ্গে কারবার করলে মানুষ মাটির মতো হয়ে যায়, আর মাটি হলো মেয়েদের জাত। আবার অন্যদিকে দেখা গেল, জমিদারের ঘরে কাজ আছে বটে কিন্তু সে-কাজ তাদের মতো মরদদের পক্ষে রীতিমতো অসম্মানের। যেমন-বাবু মাঠে গেলে গাড় বইতে হবে, মাথার করে মোট বইতে হবে, তেমন প্রয়োজন হলে বাবুর জুতোও ঘুরিয়ে দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এসব কাজে সেই দুর্ধর্ষ লাঠিয়ালদের মন সায় দেয়নি। সুতরাং, ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই বা তিনের দশক থেকে বাহাদুরপুরের লাঠিয়ালদের একটা বড় অংশই ঠেঙাড়ের পেশা বেছে নেয়। যদিও বাইরে তাদের লোকদেখানো ভড়া ছিল—নগদ পয়সার বিনিময়ে জমিদারের বিভিন্ন কাজ করে দেওয়া, যাকে বলা হতো 'লগদিগিরি'। সম্ভবত 'নগদি' শব্দটাই স্থানীয় উচ্চারণে 'লগদি' হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুরপুরের ঠেঙাফেরা রাতে কুলীতে ঘাঁটি গেছে শিকারের জন্য অপেক্ষা করত। মদের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে তাদের রক্তে আগুন লাগত, হিংস শ্বাপদের মতো তাদের চোখ জ্বলত কুচল অন্ধকারে। পথিকের সাড়া গেলে প্রায় অব্যর্থ লক্ষ্যে তারা দু-হাত লম্বা কাঁচা বাঁশের 'পাড়া' (বা 'ফাবড়া') ছুঁড়ে মারত মাটিসই করে। পায়ে পাবড়ার আধাতে পথিক মাটিতে পড়ে গেলে একটা বড় লাঠি দুদিকে পা দিয়ে শিকারের পাড়ে চেপে রেখে পা-দুটো ধরে সেটাকে উলটে দিলেই শিকারের ধাড় ভেঙে যেত। তারপর দেহটাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে আখড়াইয়ের দিঘির কাদায় পুঁতে দিত। আখড়াইয়ের দিঘির বুকে কত শত হতভাগ্যের লাশ পোঁতা আছে কে জানে। বিগত শতাব্দীর তিন-চারের দশকেও দুর্গাপুজো ও বিভিন্ন উৎসবের আগে প্রশাসনের আদেশে কুলী থেকে খড়গ্রাম পর্যন্ত রাতে চৌকিদার রাখা হতো।

খড়গাঁ থানায় একসময়ে মোগল-পাঠানে বেশ কিছু যুদ্ধ হয়েছিল। দাউদ কারনানির পরাজয়ের পরেও এই অঞ্চলে পাঠানশক্তি টিকে ছিল। মোগল সেনাপতি মান সিংহ খড়গ্রামের কাছে ভবানীপুর মোর্চায় পাঠান অসমান খাকে ধ্বংস করেন। এছাড়াও গড়গ্রামের কাছেই শেরপুর, আতাই, মারিচা ও নগরে মোগল-পাঠান যুদ্ধ হয়। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাংলার সুবাদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে বিরোধের কারণে মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন মুর্শিদাবাদে। এই সময়ে ভূষণার জমিদার সীতারাম রায় বিদ্রোহ করেন এবং মুর্শিদাবাদ জেলার বাগড়ি অঞ্চলে অর্থাৎ গঙ্গার পূর্ব পাড়ে প্রভাব বিস্তার করেন। শোনা যায়, সীতারামের পৈতৃক ভিটে ছিল এড়োয়ালীর খুবই কাছে গয়েসপুরে। গড়গ্রাম ছাড়িয়ে একটু দূরে নগরে দাদাপীর-এর 'আস্তানা' ও কম বিখ্যাত নয়। প্রতি বছর বিশে পৌন তার মৃত্যুদিবস উপলক্ষে সেখানে কয়েকদিন ধরে বিরাট মেলা বসে।

ভরতপুর থানার হিজল বিলের মতো খড়গ্রাম থানার পার্টন বিলও খুবই বিখ্যাত। মনসামঙ্গলে চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যযাত্রায় পার্টন বিলের উল্লেখ আছে। মায়ের কাছে শুনেছি, তাঁর খুব ছোটবেলায় দাদু একবার সপরিবারে মালদা থেকে জলপথে পাটন বিল হয়ে গড়গ্রামে এসে পৌঁছান। (ক্রমশ) বন্দরকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক ইতিহাসে প্রাচীন বাংলার অবদান প্রচীনকালে 'বাংলা'—এই নামে কোনো দেশ বা জনপদের অবস্থান ইতিহাসে পাওয়া যায় না। ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রদেশের নাম ও সীমা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এসমস্ত জনপদ বা অঞ্চলকে বাংলাদেশের অংশ হিসাবে মনে করা হয়- বিক্রমপুর, নাব্য (পূর্ববঙ্গের নিম্নভূমি), সমতট, হরিকেল (শ্রীহট্টের চতুর্পার্শ্বস্থ অঞ্চল), চন্দ্রদ্বীপ (বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দ্বীপ অঞ্চল), পুণ্ড্রদেশ (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম), বরেন্দ্রী (উত্তরবঙ্গ), রাঢ় (সুদ) অর্থাৎ ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরস্থিত অঞ্চল, চন্দ্রদ্বীপ (পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জ জেলা), গৌড় (সম্ভবত এটি মুর্শিদাবাদ জেলার অবস্থিত ছিল), তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়, বঙ্গ ও বঙ্গাল নামে পরিচিত সমস্ত অংশই বাংলাদেশ। সীমা হিসাবে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও দ্বীপভূমি, উত্তরে সিকিম ও নেপালের পাদদেশ, পূর্বে গারো, খাসিয়া, বরাক, সুরমা, জয়ন্তিয়া, লুসাই আরাকান পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্ণিয়া, রাজমহল (কজঙ্গল), মানভূম, বালেশ্বর পর্যন্ত বঙ্গদেশের সীমার পরিবর্তন ঘটেছে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের প্রণেতা আবুল ফজল আলোচ্য ভৌগোলিক অঞ্চলটিকে 'বঙ্গাল উপত্যকা' বলে উল্লেখ করেছিলেন। অবশ্য এর বহু পূর্বে সমুদ্র উপকূলবর্তী জাতি ও উপজাতি হিসাবে বঙ্গের উল্লেখ ঐতরেয় আরণ্যক এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ মিলিন্দপঞ্জহ ও মহানির্দেশ এ আছে। এই তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড় ও গাঙ্গে বন্দরের সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইতিহাস-চর্চা প্রাচীন বাংলার (পূর্বভারতের) ইতিহাস অনুসন্ধান ও সাধনার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড় ও গাঙ্গে বন্দরকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে বাংলায় বন্দরকেন্দ্রিক গবেষক, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এক নাগরিক সভ্যতা বিকাশলাভ করেছিল। এই উন্নত নগরী গড়ে ওঠার সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিশেষ সম্পর্ক আছে। ঐতিহাসিক বি. এন. মুখার্জির মতে—ভয়- বিক্রয়কেন্দ্র বা এলাকার মানুষের উন্নত জীবন স্থানের বাণিজ্যিক উন্নতির পরিচয় বহন করে।

আজকের দিনে অবস্থানের নিরিখে আলোচ্য প্রাচীন বাংলার (বন্দর অঞ্চল) চন্দ্রকেতুগড়, তমলুক, আটরা, হরিনারায়ণপুর, দেগঙ্গা, কাঁদি প্রভৃতি স্থানে উৎখননের ফলে প্রাপ্ত হাজার হাজার মৃত্তিকাফলক (চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুক এবং নিম্নগাঙ্গেয় অঞ্চল-সহ সমগ্র বাংলার উপকূল অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কিছু খরোষ্ঠী ও বরোধী-রাগী নিত লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিলমোহর), যাতে ধরে রাখা আছে প্রাচীন বাংলার সামগ্রিক সমাজচিত্র, দৈনন্দিন জীবনের ছায়াছবি— কেশবিন্যাস, অলংকার, পোশাক-পরিচ্ছদ, যানবাহন, সমবেত ভোজন, নৃত্য-গীত, পূজাপদ্ধতি, শোভাযাত্রা, উৎসব, দেবদেবী, দেশি-বিদেশি মানুষ, গাছপালা, পশু- পাখি, রাজসভা থেকে দরিদ্রের পর্ণকুটির পর্যন্ত। এই বন্দর এলাকায় প্রাপ্ত বিদেশি নরনারীর প্রতিকৃতিতে গ্রিক নারীদের পরিধান-সদৃশ পোশাক-পরিচ্ছদ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত মৃৎফলকে সৈনিক মূর্তির যুদ্ধসজ্জা হেলেনীয় ও রোমক রীতিসূচক। প্রাচীন বাংলায় জীবিকার সন্ধানে বাণিজ্যিক সূত্রে আগত অভিবাসীরা এখনকার চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুক অঞ্চলে স্থায়িভাবে বসবাস করতেন---যা প্রাচীন বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক তথা সমাজ জীবনের সাথে অভিবাসী এই বণিক সম্প্রদায়ের মেলবন্ধন টেরাকোটার ফলক নির্মাণকারী শিল্পীরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

কৃষিকার্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল নদীমাতৃক প্রাচীন বাংলা। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক উপাদানের বিবরণ অনুযায়ী প্রাচীনকালে উপকূল বাংলার অর্থনীতি কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করত। উর্বর সমতল মৃত্তিকা ও নদীবেষ্টিত ভূমিরূপের জন্য বর্তমানের ন্যায় প্রাচীনকালেও এই অঞ্চলের অধিবাসীরা কৃষির সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যেও বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছিল। এখানে ধান, তুলা, আখ, সরষে, নারকেল এবং সুপারি যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হতো। বগুড়া জেলার মহাস্থানে প্রাপ্ত প্রাচীন বাংলার সর্বপ্রাচীন প্রস্তর-লেখমালা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শতকে উৎকীর্ণ) ও বহু পরবর্তিকালে উৎকীর্ণ করা লক্ষ্মণ সেনের আনুলিয়, তর্পণদীঘি, গোবিন্দপুর ও শক্তিপুর তাম্রশাসনের বিবরণ অনুযায়ী ধান কৃষিজাত দ্রব্যাদির মধ্যে সর্বপ্রধান (কালিদাসের লেখা ‘রঘুবংশ’ কাব্যে ধানের চারাগাছের উল্লেখ আছে)। এই কৃষিকে সহায়ক করে প্রাচীনকালে এক দক্ষ বণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিকের বর্ণিত পেরিপ্লৌস তেস ইরিথ্রাস থালাসেস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী কার্পাস ও রেশম বস্ত্র ছিল বাংলার প্রধান বাণিজ্যিক শিল্পজাত দ্রব্য, যা সুদূর মিশর ও রোমে পর্যন্ত রপ্তানি করা হতো। এর সাথে উক্ত বন্দর এলাকা দিয়ে বিদেশে বঙ্গদেশের ধান ও আখের রস থেকে প্রস্তুত চিনি বাইরে রপ্তানি করা হতো—যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বন্দর এলাকার মৃত্তিকাগর্ভে প্রাপ্ত ধানের তুষের সন্ধান। গৃহপালিত পশুর মধ্যে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ঘোড়ার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। এপ্রসঙ্গে অধ্যাপক বি. এন. মুখার্জির মতে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে নিম্নগাঙ্গেয় বঙ্গে ঘোড়া আমদানি করে তাকে নানাভাবে সুশিক্ষিত করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও চীনে উচ্চ মূল্যে রপ্তানি করা হতো। এছাড়া যুদ্ধের প্রয়োজনে হাতি পোষা হতো। হাতির দাঁত ও হাড়ের তৈরি সৌখিন জিনিস বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ গুরুত্ব পেত। ঐতিহাসিক ডঃ অতুল সুরের মতে, প্রাচীন বাংলার তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় বর্ণ ও জাতি বিভাজনের আধিক্য ছিল না। অনুমেয় হয়, প্রাচীন বাংলার সমাজব্যবস্থায় বর্ণ ও জাতি বিভাজনের আধিক্য না থাকায় বাণিজ্যিক প্রয়োজনের তাগিদে নিয়োজিত সুদক্ষ শিল্পীরা শিল্পের বিভাজন অনুযায়ী (কর্মকার, অলংকরণরত খোদাইকর, তন্তুবায়, কুম্ভকার প্রমুখ নামে পরিচিতি লাভ করতেন এবং তাঁদের উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের জন্য সমাজে সমাদর পেতেন। বিশ্ব বণিজ্যিক ইতিহাস অনুযায়ী খ্রিস্টীয় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে ভারত-রোম বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ঘটে। তখন প্রাচীন বাংলার তাম্রলিপ্ত, গাঙ্গে ও চন্দ্রকেতুগড় বন্দরের সামুদ্রিক বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করত। এইসব বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি থেকে রোমান পানীয়পাত্র অ্যাম্ফোরার অনুকরণে নির্মিত মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। সর্বোপরি, ভারতীয় কিছু মুদ্রায় রোমান ‘দিনার'-এর উল্লেখ রোম-ভারত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে। রোম থেকে আগত ব্যবসায়ীরা সম্ভবত অভিবাসিরূপে ঘোড়া ও চালের ব্যবসায়ে অংশ নিত। বাংলা থেকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে (শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ, চীন) রপ্তানির তালিকায় ছিল ঘষা কাচ, খুব উঁচু দরের সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র, রেশমের বস্ত্র, চাল ইত্যাদি। সোনা, রুপা, পট্টবস্ত্র, কড়ি প্রভৃতি আমদানি করা হতো। বিনিময়ে রপ্তানি করা হতো হিমালয় অঞ্চলজাত তেজপাতা ও কয়েক প্রকার গুল্ম পিষে তৈরি সুগন্ধ তেল এবং মুক্তা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর ক্ষেত্রে সোনা ও রুপাকে (মুদ্রা হিসাবে) গুরুত্ব দেওয়া হতো। বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম মুদ্রাগুলি ছিল অঙ্ক-চিহ্নিত। অধ্যাপিকা সুস্মিতা বসু মজুমদারের মতে, বাংলার অন্তত তিনটি অঞ্চল প্রাথমিক পর্বে তাদের নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করত—ঢাকার নিকট অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামাঞ্চল, দ্বিতীয়টি উত্তর চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড় অঞ্চল ও তৃতীয়টি তাম্রলিপ্ত তথা বর্তমান মেদিনীপুর অঞ্চল। তবে উপকূল বাংলার নানা স্থান থেকে বেশ কিছু কুষাণ স্বর্ণমুদ্রার সাথে বহু সংখ্যক গুপ্ত, পরবর্তী গুপ্ত ও শশাঙ্কের স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা প্রাপ্তি হলো- ১৭৮৩ সালে কালীঘাট থেকে গুপ্তদের প্রাচীনতম মুদ্রাভাণ্ডার আবিষ্কার, যার মধ্যে প্রায় ২০০টিরও (ভাণ্ডারটিতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত, দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত এবং বিষ্ণুগুপ্তের মুদ্রা ছিল) বেশি মুদ্রা সঞ্চিত ছিল। বাংলায় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সাথে বেশ কিছু তাম্রমুদ্রা এবং পরবর্তিকালে পাল ও সেন যুগে মুদ্রা হিসাবে কড়ির বস্ত্রের। কার্পাস তুলো থেকে প্রস্তুত কাপড়েরও যথেষ্ট ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিল। দ্রব্য-বিনিময়কে মাধ্যম করে সুখ্যাতি ছিল। জলপথে নদীমাতৃক উপকূল বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য দেশের (ভারতের) সীমা অতিক্রম করে চীন, সুবর্ণভূমি, মালয় উপদ্বীপ (মলয় উপদ্বীপের ওয়েলসলি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ ব্রাহ্মী লিপিযুক্ত পোড়ামাটির একটি সিলে রক্তমৃত্তিকা বা কর্ণসুবর্ণ থেকে আগত জনৈক মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়), যবদ্বীপ, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশে প্রসারলাভ করেছিল। আবার স্থলপথে নিম্নগাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের (তাম্রলিপ্তের) সাথে উত্তর-পশ্চিম ভারতের (বারিগাজা, সোপারা, ভরুকচ্ছ, কল্যাণ বন্দর অঞ্চলের) এবং পাটলিপুত্রের যোগাযোগ ছিল। প্রাচীনকালে এই জলযানকে মাধ্যম করে ভারতের সাথে রোম সাম্রাজ্যের ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক বি. এন. মুখার্জি মনে করেন, প্রাচীনকালে ভারত-রোম বাণিজ্য সূত্রে বঙ্গদেশের দ্রব্যাদি দক্ষিণভারতে নিয়ে যাওয়া হতো এবং সেখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যে চালান দেওয়া হতো। আবার অধ্যাপক দিলীপকুমার চক্রবর্তী প্রাচীন বাংলার সাথে রোমের প্রত্যক্ষ বাণিজ্যের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে ১৯৯৪ সালে কাঁথি থেকে প্রাপ্ত রোমান পাত্র অ্যাম্ফোরার কথা উল্লেখ করেছেন।

ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র অনুযায়ী চারিদিক নদীবেষ্টিত বাংলায় ধান, তুলা, আখ, সরষে, নারকেল এবং সুপারি যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হতো। চন্দ্রকেতুগড় থেকে ধানের তুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিক বি. এন. মুখার্জির মতে, বাংলা থেকে কুষাণ আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাহাজে করে শস্য রপ্তানি করা হতো। এছাড়া প্রাচীন বাংলা অনাদিকাল থেকেই বস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানে তুলা ও রেশমগুটি চাষ হতো যথেষ্ট পরিমাণে—যা দিয়ে উৎপন্ন বস্ত্র গ্রাম ও নগরের প্রয়োজন মেটাত। এর সাথে এই বস্ত্র বাংলা থেকে দেশ-বিদেশে বাণিজ্যে রপ্তানিজাত দ্রব্যের মধ্যে ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এ ক্ষৌম, দুকুল, পাত্রার্ণ ও কার্পাসিক নামে বঙ্গের চারপ্রকার বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কৌটিল্যের মতানুযায়ী বাণিজ্যিক গুরুত্ব বেশি ছিল বঙ্গদেশীয় স্নিগ্ধ ‘দুকুল'

জাহাজে চাপিয়ে ঘোড়া আমদানির রীতি প্রচলিত ছিল এবং বিদেশ থেকে ভারতে আমদানিকৃত সবথেকে দামি জিনিস ছিল ঘোড়া। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন—পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সী গ্রন্থে বর্ণিত ‘গাঙ্গে বন্দর' এবং বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকে নির্মিত 'তাম্রলিপ্ত বন্দরের' সাহায্যে নিম্ন গাঙ্গেয় অঞ্চলের সাথে পশ্চিমভারতের ভৃগুকচ্ছ এবং দক্ষিণভারতের দ্রাবিড় দেশ ও এখান থেকে রোমের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের বিশেষ বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচীন মৌর্য এবং কলিঙ্গ রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হলো তাম্রলিপ্ত (এই বন্দরটির অবস্থান ছিল উপকূল বাংলার তমলুকে)। এটি ছিল একটি বড় বন্দর এবং এখান থেকে পণ্য-বোঝাই জাহাজগুলি সিংহল (শ্রীলঙ্কা), সুবর্ণদ্বীপ এবং মায়ানমারের দিকে রওনা হতো। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য সম্রাট অশোক তাঁর কন্যা সংঘমিত্রা এবং পুত্র মতান্তরে ভাই মহেন্দ্রকে দিয়ে বোধিবৃক্ষের একটি চারা তৎকালীন শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের শাসক দেবনামপ্রিয় তিষ্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন। চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে একজন বণিকের জাহাজে পনেরো দিন সমুদ্রযাত্রা করে সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) পৌঁছেছিলেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে লিখিত পেরিপ্লাস গ্রন্থে অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিক উল্লেখ করেছেন ভারতের বৃহত্তম নদী গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত বন্দর গাঙ্গে সম্পর্কে। এই নদীর তীরে হাট, শহর বা গঞ্জ আছে। গাঙ্গেয় অঞ্চলে উৎপন্ন মসলিনের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে এই বন্দর অঞ্চলে বড় বড় জাহাজের বিশেষ যাতায়াত তৎকালীন সময়ে ছিল। থঞ্চি থেকে প্রাপ্ত নৌকার ছবি মুদ্রিত একটি সিলমোহর 'গোবর্ধনপুর সুন্দরবন প্রত্ন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। ব্রাহ্মী হরফযুক্ত এই সিলমোহরে অঙ্কিত নৌকার মাস্তুলে একটি পাল টাঙানো রয়েছে। আবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার তিলদাহ থেকে একটি পোড়ামাটির গ্রিক লিপি-যুক্ত ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে অজানা এক গ্রিক নাবিক তাঁর বাণিজ্যযাত্রা সফল হওয়ার জন্য পূর্বদিকের বাতাসকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। স্ত্রী সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, বাণিজ্যের প্রসার ও উন্নত অর্থনীতির পরিচায়ক হলো মুদ্রা। তমলুক, চন্দ্রকেতুগড় ও নিম্নগাঙ্গেয় অঞ্চলের নানা স্থান থেকে মৌর্য, কুষাণ ও গুপ্ত যুগের অসংখ্য মুদ্রা প্রাপ্তি প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ বাণিজ্যের সূচক। বাংলার নানা স্থান থেকে ভারতের প্রাচীনতম মুদ্রা প্রায় দুহাজার বছর আগে নির্মিত ছাঁচে ঢালাই মুদ্রা (Cast copper coin) এবং Silver punch mark coin পাওয়া গেছে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে নবম শতকের শেষভাগ পর্যন্ত কাঞ্চিপুরমকে কেন্দ্র করে দক্ষিণভারতে আধিপত্যবিস্তারকারী পল্লব রাজাগণ তাঁদের মুদ্রায় বৃষ ও বৃক্ষের সাথে জলযানের প্রতীকচিত্র অঙ্কন করতেন। যে-কারণে ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন, পল্লবরা সেই সময়কালে বাণিজ্যের প্রয়োজনে জলযান নিয়ে দূর দেশে পাড়ি জমাতেন। বাংলার উয়ারী-বটেশ্বর, চন্দ্রকেতুগড়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হরিনারায়ণপুর ইত্যাদি স্থান থেকে অনুরূপ প্রতীক অঙ্কিত বেশ কিছু ‘বিলন' (রুপা ও তামা মিশিয়ে ‘বিলন' নামে এই সংকর ধাতুর মুদ্রা নির্মাণ করা হতো) মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। হরিনারায়ণপুর থেকে প্রাপ্ত মুদ্রার সাথে সাম্প্রতিককালে বীরভূম জেলার কোটাসুরে খননকার্যের ফলে অনুরূপ জাহাজের মোটিফ-সহ দুটি তামার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুক অঞ্চলে একধরনের মৃত্তিকা-ফলক পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যায়—দেবী, যক্ষিণী অথবা লক্ষ্মী কলসি উপুড় করে মুদ্রা ঢেলে দিচ্ছেন আর ভক্তরা সেই মুদ্ৰা থালাভর্তি করে নিচ্ছে। অনুরূপ ফলক বাংলার এই দুই স্থানের প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেছে, যেখানে দেখা যায়—একটি পূর্ণ কলস থেকে উপচে পড়ছে মুদ্রারাশি। এই শ্রেণির ফলক যে প্রাচীন বাংলার এ-দুটি বন্দরনগরীর ঐশ্বর্য ও সচ্ছলতার বার্তা বহন করছে তা বোধ হয় নিঃসন্দেহে বলা যায়। সমুদ্রযাত্রায় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া ও বাণিজ্যে সাফল্যলাভের আশায় প্রাচীন বাংলার বণিকশ্রেণি নানা ধরনের দেবদেবীর পূজার মাধ্যমে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছেন, যার প্রমাণস্বরূপ বাংলার নানা স্থান থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির মূর্তির মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি—যক্ষ-যক্ষী, লক্ষ্মী, কুবের, গণেশ, গঙ্গা ইত্যাদি। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল প্রাচীনকালে—রোমান বণিকদের সমুদ্রযাত্রার পূর্বে পোতাধ্যক্ষ ও নাবিকদের পৃষ্ঠপোষক দেবী আফ্লোদিতের পূজার্চনার মাধ্যমে দৈব অনুগ্রহ প্রার্থনা করা হতো; এছাড়া বণিকরা যাত্রাপথে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রকে তুষ্ট করার জন্য মণিরত্ন ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য জলে অর্পণ করে পূজা করতেন এবং তাবিজ ধারণ করতেন। তমলুক অঞ্চল থেকে এরূপ একটি মাটির তাবিজ পাওয়া গেছে। তাবিজটির ওপরে খরোষ্টী-ব্রাহ্মী লেখতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে—‘সমুদ্রে (বিপদে) দ্বিজের স্মরণ নেবে'। এভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ের মধ্যে দৈব আরাধনা সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। দৈব আরাধনার বিবিধ রূপের অন্যতম রূপকার ছিলেন প্রাচীন বাংলার বণিক শ্রেণি।

সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকবর্গ বাংলার নানা স্থানে ব্যাপক উৎখনন ও অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সাথে প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের মেলবন্ধনের প্রচেষ্টা নিরন্তর করে যাচ্ছেন, যার ফলস্বরূপ অতীতের বহু অজানা ইতিহাস ক্রমাগত প্রস্ফুটিত বা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়ে চলেছে। বেশ কিছু অজানা বা তথ্যের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, ভৌগোলিক দিক থেকে নিম্নগাঙ্গেয় সমভূমিতে অবস্থানের কারণে কৃষির সাথে প্রাচীন বাংলার অধিবাসিবৃন্দের বাণিজ্যিক সুখ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এই বাণিজ্যিক প্রভাব বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিবিধ প্রত্ননিদর্শনগুলি তারই সাক্ষ্য প্রদান করে।




0 Reviews