Read more
সাঁওতালী ভাষা ও সারি ধরম ভাবনা
ভারতের আদিম অধিবাসী সাঁওতাল। সরকারী ভাবে তাঁরা তপশিলী উপজাতি বা আদিবাসী হিসাবে পরিচিত। সাঁওতাল নাম অবশ্য অন্য জাতির দেওয়া নাম বা আরোপিত নাম হলেও সাঁওতালরা সাঁওতাল নাম ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। অন্যথায় তারা একটি পরিচিতির এটকে টড়তে বা সঙ্কটের সম্মুখীন হয়ে চলতে হত।
তাঁরা নিজেদের মধ্যে ‘হড়’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন যার অর্থ মানুষ। পশু নয়। তাহা ছাড়া নিজেদের খেরওয়াল বংশের লোক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁদের বংশের নাম খেরওয়াল। সাঁওতালরা খেরওয়াল জাতি। এ নামে তারা আজ থেকে নয়, আবহমান কাল থেকেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে আসছেন। অন্যদের কাছে অন্য নামে পরিচয় দিতে হয় তা না হলে অন্যরা বুঝবেন না। অপরের দেওয়া নামই এখন সুন্দর সম্মানের ও সুবিধার হয়ে গেছে বা পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গিয়েছে।
এই তো সেদিন ১৯৬০ সালের পূর্বে সাঁওতালদের ভাষাকে ‘ঠার’ বলা হত। ঠার মানে ঠারে ঠোরে বা ইঙ্গিতে আকারে ভাব প্রকাশ করা। সাঁওতালদের ভাষাকে বুঝবার জানবার চেষ্টা করা হয় নাই। মর্য্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা। অপর দিকে তাঁরা যা বলেন তাতে সায় দিয়ে চলতে হত। দুটো কেন আর একটা প্রজন্ম কেটে গেলে ভাষার ছিটে ফোটা যা আছে তাও মুছে যাবে। এ ভয় আছে।
সাঁওতালদের জমির দলিলে, রেশন কার্ডে, চাকুরীর সাক্ষাৎকারের চিঠিতে, হাসপাতালের কাগজ পত্রে নাম ঠিকমত লেখা হয় না। কারণ অন্যভাষী অফিসার কর্মীরা সাঁওতালী ভাষার নামের উচ্চারণ ধরতে পারেন না। বাংলায় বা ইংরাজীতে সাঁওতালী শব্দ লেখা যায় না। লিখতে গেলে শব্দ বিকৃত হয়ে যায়। এটাও ভুলের একটা কারণ। তাই নাম লিখতে ভুল করেন। নামটা কিম্ভূতাকার হয়ে যায়।
শুদ্ধ করে লিখতে বললে চোখ রাঙানি বা ধমক খেতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুদ্ধ করে লেখা গেলেও উচ্চারণ ধরতে না পারার জন্য তারা ভুল লেখেন। এর পরিণাম কি সাঙ্ঘাতিক হয় ভুক্ত ভোগীরাই জানেন। কিন্তু একজন মুসলমান বা মাদ্রাজীর লম্বা চওড়া উচ্চারণ বিশিষ্ট নাম লিখতে ভুল করেন না। কারণ কি এখানে তাদের একটা স্বীকৃতি বা সমীহ গোছের একটা ভাব কাজ করে। সাঁওতালদের নাম সে ভাবে লেখা হয় না।
কি ‘কিড়িং বিড়িং' বলে উপেক্ষা করে যেমন তেমন ভাবে লিখে ছেড়ে দেওয়া হয়। সাঁওতাল অশিক্ষিত বা মুর্খ হলে পরে বুঝতে পারেন এটা তার নাম নয়। এভাবে তারা সমস্যায় পড়ছেন। নামটা তার উল্টো হয়ে যায়। যিনি লিখেছেন তিনি বললেন এটা তোমার নয়, তোমার কাজ হবে না। এভাবে কত কাজ ভুল হচ্ছে। তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। সাঁওতালদের প্রতি একটা উপেক্ষা বা তাদের জন্য ঝামেলা বোধ কাজ করছে। অবশ্য এটা ব্যতিক্রম নয়, এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
আর একটা কথা, সাঁওতাল তথা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার কোনো গ্রামের নাম ও আদিবাসীদের উচ্চারণের দোষে দুষ্ট হয়ে নূতন নামে বা বিকৃত নামে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং করছে। আদিবাসীরাও শুনে শুনে, এই নামই ভাল লাগছে তাঁদের কাছে। ভ্রষ্ট নামে নামাংকিত হতে, বিকৃত কদাকার হতে ভাল লাগছে। যেমন 'কথামৃত মের অমৃত কথার মেছুনীর মাছের আঁশটে গন্ধই ভাল, ফুলের গন্ধে তার শ্বাস রোধ হয়। কিন্তু আদিবাসী তথা সাঁওতালরা ফুল ভালোবাসেন, ফুল যে তাঁদের আত্মা, অমর ফুল। ‘বাহা বঙ্গা’ বা ‘বাহা পরব' তার সাক্ষী। এ কথা ভুলবার নয় যে তাঁর। শব্দ পরিবর্তন ভাব বিনিময় না ভাব বিপর্যয়।
এভাবে শব্দ বা নাম পালটে যাওয়া একটা ইতিহাস বটে। এ অবস্থায় আসল নকল চেনা মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁদের ভাষা (সাঁওতালী) নিয়ে সন্দ নয়, কি হয় । কি হয় । ভাষা ভগবানের সৃষ্টি। ভাষার বৈচিত্র্য ভগবানের সৃষ্টি। বৈচিত্র্যই সভ্যতার প্রাণ। বিভিন্ন পাখির বিভিন্ন ডাক। কাক কোকিলের ডাক এক নয়। সব পাখির ডাক এক হলে ভগবানের মহিমা কোথায় নেমে যেত। ভাল চাইলে এক চাইব না। এক ডাক থাকুক, বহু ডাক থাকুক। তবেই তো আনন্দ। আনন্দ মারার ব্যবস্থা ভগবানের সৃষ্টিতে নেই ।
এ গেল ভাষার কথা। লোক গণনায় সাঁওতাল বা আদিবাসীদের ধর্মের নাম সাধারণতঃ লেখা হয় না। বললেও লোক গণনায় কর্মী বাবুরা ধর্মের কথা শুনে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। অথচ জাতি, ধর্ম, ভাষা, স্ত্রী ও পুরুষ ইত্যাদি বিবরণ লেখার নিয়ম আছে। তা মানা হয় না। ধর্মের নাম জিজ্ঞাসা করা হয় না। সেটা তাঁরা পূরণ করেন। এটা আদম সুমারী না মহামারী। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব যে সত্য মিথ্যা প্রমাণ করা মুসকিল। সর্বত্র ‘পেটের বাড়ে' বিচার চলছে।
অন্যেরা আদিবাসীদের অর্থনৈতিক দূরবস্থা বা অধঃ পতিত অবস্থা দেখে তাদের ভাষা, ধর্ম, সমাজ সংস্কৃতি, শিক্ষা সব কিছুই যেন পতিত দোষে দুষ্ট, এ ভাব পোষণ করেন। দূরবস্থার কারণ লক্ষ্য করেন না। সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভাব ও বস্তু দুইই আছে, তাঁরা খবর রাখেন না। যার নাম খারাপ এই নীতিতে চলেন তাঁরা।
অপরের ছিদ্রান্বেষণ করা সহজ। কিন্তু নিজেদের ছিদ্র অন্বেষণ তদ্রুপ সহজে বোধগম্য হয় না। দৃষ্টি গোচর হয় না। কে কোথায় যাবেন নিজের পায়ে টেগঁচ মারুন। না হলে কবর খুঁড়ে রাখুন। মৃত্যু আসন্ন। নিজের ভাষা, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতিকে জানতে হবে। অপরেরও জানতে হবে। শ্রদ্ধা করতে হবে। নিজের সংস্কৃতি অপরকেও জানাতে হবে। নিজের ভালটা রাখতে হবে। মন্দটা উৎপাটন করতে হবে। ভাল মন্দ লোক আছে। লোকের অভাব নেই। অপরে তো মজা মারবেই। ভেড়ার মত লড়াই লাগাবে। ভাবনা কি। আপনা হাত জগন্নাথ। নিজের মাথা স্থির রাখতে হবে। দক্ষ হাত সচল রাখতে হবে। অপরের ভুল ভাঙ্গবে। কর্মই ধৰ্ম, সে তো সাঁওতাল পূর্ব পুরুষেরা কারাম বিন্তিতে দিয়ে গেছেন। ভুললে চলবে না। করমগে ধরম। সারি গে ধরম।
মুখে মুখে প্রচলিত, গুরু শিষ্য বা বৃদ্ধ বৃদ্ধা পরম্পরা প্রাপ্ত পৌরাণিক ‘বিন্তি’ (বিবৃতি) কাহিনী ‘কুদুম’ (তিৰ্য্যার্থক বাক্য) ‘অঁড়হে' (পূজা কালীন গীত সংগীত) ‘বাঁখেড়’ (গদ্য আকারে পূজার প্রার্থনা মন্ত্র) এবং 'সেরেঞ' (গান) ইত্যাদি ভাষার দৌলতে পাওয়া গেছে।
ভাষাই বহন করে চলেছে এবং বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ ভাষায় এগুলি শ্রুতি সাহিত্য বিধৃত হয়ে আছে। কালের প্রভাবে বহু হারিয়ে গেছে। মুখে মুখে ঘুরে কিছু নূতন রূপ পরিগ্রহ করেছে বা বিকৃত হয়ে গেছে। বিস্মৃতির অন্তরালে কত তলিয়ে গেছে তার ইয়ত্বা নেই। কারণ এগুলি লিপিবদ্ধ ভাবে সংহত আকারে ছিল না । ইদানিং সংগ্রহ করে গ্রথিত করে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস চলেছে এবং হচ্ছে। অনুবাদ ও গবেষণাদিও শুরু হয়ে গিয়েছে। আদিবাসীকে জানবার, চিনবার এগুলি অমূল্য উপাদান । সামাজিক ও মানসিক সম্পদও। বেদকে শ্রুতি বলা হত। কিন্তু সাঁওতাল আদিবাসীদের উপরোক্ত তত্ত্ব ও তথ্যাদি এখনও শ্রুতি রূপে বিরাজমান । শ্রুতি এটাকেও বলব। বেদ এর অর্থ জ্ঞান। বেদ মানে জানা। বাড়ায় মানে জানা। বিড বা বাড়ায় সাঁওতালী শব্দ। সামবেদে গান আছে। যজ্ঞের সময় গীত হত। অনুষ্ঠানাদির সময় কথা নেই, শুধু গান, গান দিয়ে কথা। গানগুলি অনুষ্ঠানের পর্যায়ে ক্রমিক রূপে রচিত।
সামাজিক কোন কর্ম বা ক্রিয়া কাণ্ডের সূচনা অতি সুন্দর রূপক গল্পের মাধ্যমে সূচিত করা হয়। সরাসরি সাদা মাঠা কথায় শুরু হয় না, তাহা ঐতিহ্য বিরুদ্ধ। কথার তাৎপর্য্য আছে, তার ব্যঞ্জনাও আছে। এমনই আদিবাসীদের ভাষা।
কিছু বিন্তি কাহিনী রূপক আধারে বলিষ্ঠ উপমা সহযোগে সূত্রকারে কথিত আছে। যার অর্থ সহজে ধরা পড়ে না। গুরু বা প্রবীণ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার কাছে জেনে নিতে হয়। পূজোর বাঁখেড় গদ্যের আকারে অপূর্ব সাহিত্য শৈলীতে এবং কাব্যের ঢং এ উক্ত আছে। পৌরাণিক বিন্তিতে আছে সৃষ্টি, দেব-দেবী, মানুষের জন্ম-মৃত্যু। জীবন জীবিকা, বিবাহ আদি সংস্কার ইহাও পারলৌকিক কর্মাদির বিবরণ আছে। তাহা ছাড়া মানুষের আগমন গমনাদি, স্থানান্তরণ, তাদের সুখ সমৃদ্ধি, দুঃখ, বঞ্চ নার কথাও আছে।
সাঁওতাল পুরাণে আছে (বিন্তিতে) তাঁদের জন সংখ্যা বেড়ে গেলে, তাঁদের জীবনে সুখ রইল না। দুঃখ-দুর্দশা নেমে এল। দুঃখ-দুর্দশায় জীবন দগ্ধ হতে লাগল । এই দুঃখ- দুর্দশার কারণ জানা, তার নিরসন ও নিবৃত্তির জন্য তাঁরা 'লাগাচার পাঁজা’ বা ‘ধরম পাঁজা'র (সংস্কৃতির সন্ধান বা ধর্মের অনুসন্ধান) জন্য যাত্রা করলেন।
প্রথমে তাঁরা হেচং বাং চং, বৃক্ষের নিকট গমন করলেন। সেখানে তাঁরা দশ বিশ বছর ধরে আচার বিচার করলেন। হেচং বাং চং বৃক্ষের নিকট সব হেচং বাং চং হয়ে গেল। হেচং বাং চং বৃক্ষটি কোন বিচার দিতে পারল না। সব বিচার হেচং বাং চং হয়ে রইল। হেচং বাং চং মানে সংশয়। এটি ঠিক, পরক্ষণেই না, এইরূপ বিচারকে সংশয় বলে। হেচং বাং চং-বৃক্ষ সংশয় রূপ বৃক্ষ। সংশয় পূর্ণ বিচার দিল।
এরপর বিচারে সংশয় হওয়াতে তাঁরা স্থান ত্যাগ করলেন। বিচার সভা এল 'বাড়িচ বাদরি' বৃক্ষের নিকট। সেখানেও দশ বিশ বছর আচার বিচার চলল। এখানেও বাড়িচ বাদরি বৃক্ষটি বিচার সভাকে বাড়িচ বিচারই দিল। বৃক্ষটি সৎ আচার, সৎ বিচার দিতে পারল না। এখানে সব বিচার বাড়িচ সাড়িচ হয়ে গেল। অর্থাৎ সব বিচার বাড়িচ অর্থাৎ মন্দ বা খারাপ হল। বাড়িচ মানে খারাপ। বাদরি মানে একটি বিশেষ বৃক্ষের নাম। যার নামে দাঁড়ায় খারাপ বাদরি। খারাপ বাদরি বৃক্ষটি খারাপ বিচার জ্ঞাপন করল।
বিচার খারাপ হওয়াতে তাঁরা ঐখান থেকে সরে এলেন। তাঁরা এঁড়ে আতনা বা লাবাড় আতনাঃ দারে বুটাতে (তলায়) বিচার সভা বসালেন। এখানেও দশ বিশ বছর ধরে আচার বিচার করলেন। ‘এঁড়ে আতনাঃ’ বা ‘লাবাড় আতনাঃ’বৃক্ষটিও এড়ে (মিথ্যা) আচাড়, এঁড়ে (মিথ্যা) বিচার জ্ঞাপন করল। সৎ আচার, সৎ বিচার বা সসিদ্ধান্ত দিতে পারল না। সব বিচারই তার মিথ্যাচারে পরিণত হল, অর্থাৎ, এঁড়ে (মিথ্যা) হল। এবং সব বিচারই লাবাড় (প্রবাদ) বা ব্যর্থ হয়ে গেল প্রমাদের জন্য। কারণ বৃক্ষটি ছিল এড়ে আতনাঃ বা লাবাড় আতনাঃ যার অর্থ মিথ্যা আতনাঃ বা প্রমাদ আতনাঃ। মিথ্যাচারীর বিচার মিথ্যা এটাই তাৎপর্য্য। প্রমাদে বিচার ভ্রষ্ট হল। প্রমাদ যোগের অন্তরায় ধর্মের অন্তরায়। মিথ্যাচারেরও তাই।
চতুর্থবারে তাঁরা ‘লেপেচ তেরেল দারে'র নিকট দশ বিশ বছর ধরে আচার বিচার করলেন। এখানেও সব বিচার ভেস্তে গেল। বিচারে জল ঘোলা হল। সব বিচারই লেপেচ্ চাপাঃ হয়ে গেল। লেপেচ চাপাঃ মানে অন্তঃসার শূন্য কথা বা বিচার শুধু বাগাড়ম্বর। বাক মানে সর্বস্বতা মাত্র। লেপেচ তেরেল; লেপেচ মানে এখানে অতি পাকা ফল যাহা খাওয়ার অযোগ্য বা ব্যবহারের অযোগ্য তেরেল–কেন্দু বৃক্ষ। এমন কেন্দু বৃক্ষ যার ফল অতি পাকা জনিত খাওয়ার অযোগ্য তাহাই লেপেচ তেরেল। এরূপ বৃক্ষের নিকট সব বিচার অতি পাকামীতে শেষ হল। সদ্ বিচার এখানেও পাওয়া গেল না; এ কথাই বলা হয়েছে।
এখান থেকে প্রস্থান করে ‘খোদে মাতকুম বুটাতে' তাঁরা বিচারের আশায় উপস্থিত হলেন। তার কাছেও দশ বিশ বছর ধরে আচার বিচার হল। খোদে মাতকুম বুটাতে মানে খুদে মহুয়া বৃক্ষের তলায়। এখানে সব বিষয়ই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে, তন্ন তন্ন করে সূক্ষ্ম চুলচেরা বিচার হল। ভাল ও মন্দ দুই দিকই বিচার হয়েছিল। কোনটি ভাল কোনটি মন্দ। বুদ্ধির কসরৎ বেশি হয়েছিল। এখানে হৃদয় ছিল না, শুকনো বুদ্ধির বিচার ছিল। তাই এই বৃক্ষের নিকটও যোগ্য বিচার বা যোগ্য আচারের কথা পাওয়া গেল না। পূর্বেকার তুলনায় বিচার কিছু ভাল ছিল। এই বৃক্ষটিকেও তাঁরা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।
তাঁরা উপস্থিত হলেন পেটের বাড়ে বৃক্ষটির নিকট। ‘পেটের বাড়ে' পেটের মানে পেঁচালো বা পাকানো। বাড়ে দারে মানে বট বৃক্ষ। এক সঙ্গে অর্থ করলে দাঁড়ায় পেঁচিয়ে উঠা বট বৃক্ষ। সেখানেও তাঁরা দশ বিশ বছর আচার বিচার করলেন। পেটের বাড়ে তলায় সব বিচার ভাবনা কুটিল ও জটিল হয়ে উঠল। সরল বিচার হল না। সরলতার ভয়ংকর অভাব দেখা গেল। “পেটের বাড়ে বুটারে ঝত কাথাগে পেটের জেঠের এনা।” তার মানে পেঁচালো বট বৃক্ষের তলায় সব বিচার কুটিল ও জটিল আকার ধারণ করল। কুটিল আচার, পেঁচালো বিচার ঠিক নয় বলে সিদ্ধান্তের অভাবে তারা পেটের বাড়েকেও ত্যাগ করলেন। অন্যত্র যাত্রা শুরু করলেন। দুঃখের কারণ জানতে হবে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় জানতে হবে।
এভাবে বহু বছর অতিক্রান্ত হল। বিচারের সমাধান পেলেন না। অবশেষে তাঁরা ‘সারি সারজম’ বৃক্ষের নিকট উপস্থিত হলেন। সেখানেও তাঁরা দশ বিশ বছর ধরে ধৈর্য্য নিষ্ঠা সহকারে আচার বিচার করলেন। বহু বছর আচার বিচারের ফল এখানে মিলল। সারি সারজম বৃক্ষের নিকট তাঁরা পেলেন সত্য আচার। এই সদাচার তারা লাভ করলেন। তাঁরা উপলব্ধি করলেন সদাচারই ধর্মের মূল। সত্যই ধর্ম, সারি গে ধরম। সত্য বা সদাচার ছাড়া ধর্ম হয় না। সত্য যুক্ত কমই ধর্ম। সব বিচার সব আচার সত্যে শেষ হয়েছে। সত্যের পর বিচার আচার চলে না। অসত্য, অধর্ম বা পাপ, দুঃখের হেতু। সত্যই মুক্তির পথ। ভগবান সত্য স্বরূপ। ধর্মও সত্য কারণ ধর্মে সত্য আছে। সারি সারজম বৃক্ষের নিকট সত্য লাভ হল তাই সাঁওতাল তথা আদিবাসী ধরম গুরুরা তাদের ধর্মের নাম করণ করলেন সারি ধরম। সত্যই ধর্ম। সারি ধরম। এ সারি ধরম নিত্য, শ্বাশত বা সনাতন বা 'লাঁসাড় হেৎ গে'। সত্য শাল বৃক্ষের নিকট পাওয়া গেছে বলে শাল বৃক্ষের তলায় জাহের থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই কোন আদিকাল থেকে। সেখানেও অধিষ্ঠিত দেবতা হলেন মারাং বুরু। জাহের এরা, মড়েক তুরুই ক সব রকমের ধর্মীয় পূজা, অনুষ্ঠান এখানেই হয়।
ইহা অতি পবিত্র স্থান। স্থানটি গ্রামের অদূরে অবস্থিত। সাঁওতালরা 'সারি' - ধর্মাবলম্বী। তাঁরা হিন্দু বলে স্বীকার করে না। 'জাহের' শব্দটির ব্যাখ্যা করলে অর্থ পাওয়া যায়। জ + এর = জাহের। 'জ' মানে ফল, ফল অর্থে পুণ্যফল বা ধর্মফল। ‘এর’ অর্থ ছড়ান বা ছড়ানো। জাহের থেকে ফল বর্ষিত হয়। পুণ্য ফল বর্ষিত হয়। জাহের এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন জাহের এরা। এখানে এরা মানে স্ত্রী বা আয়ো অর্থাৎ মাতা। জাহের মাতা, পুণ্য ফল প্রদানকারিনী মাতা। জাহের এরা। ধর্ম পালন করলে পুণ্যফল ঝরে পড়ে। এটাই মর্মার্থ। কর্মফল কাউকে ছাড়ে না।
গাছকে কেন্দ্র করে এই বিস্তিটির তাৎপর্য কি? এক একটা গাছ এক একটা আচারের বা মানসিক বৃত্তির প্রতীক। রূপকের আশ্রয়ে আচারের বা কর্মের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রথমতঃ হেচং বা চং অর্থাৎ সংশয়। সংশয়াত্মিক বৃত্তিতে সত্য পাওয়া যায় না। তাহা যোগ বা ধর্মের অন্তরায়। যোগর্ষি পতঞ্জলি তাঁহার বিখ্যাত যোগ দর্শনে সংশয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সাঁওতাল গুরুরাও তার দৃষ্টান্ত দেখাতে ভুল করেন নি।
দ্বিতীয়ত : বাড়িচ বাদরি বৃক্ষের কথা। বাড়িচ মানে নিষিদ্ধ কর্ম বা আচার। নিষিদ্ধ কর্ম না হয় সদ্ আচার না হয় সদ্ কর্ম। ইহা ধর্ম বা সত্যের বিঘ্ন।
তৃতীয়ত ঃ এড়ে আতনাঃ বা লাবাড় আতনাঃ এই বৃক্ষ দুটির সাহায্যে মিথ্যাচার এবং প্রমাদ বৃত্তির কথা বোঝানো হয়েছে। মিথ্যাচার ও প্রমাদে ধর্ম লাভ হয় না। প্রমাদ যে যোগের বিঘ্ন পতঞ্জলি তাহাও উল্লেখ করেছেন।
চতুর্থত : বৃক্ষটি হচ্ছে লেপেচ তেরেল দারে। এই বাক্য দ্বারা বাক সর্বস্বতা ও তার অন্তঃসার শূন্যতা বোঝানো হয়েছে। শুধু মুখের কথায় ধর্ম হয় না তাতে সত্য রূপ সার থাকা প্রয়োজন। ইহা সদাচারের পর্যায়ে পড়ে না।
পঞ্চ ম ঃ খোদে মাতকম বৃক্ষ বা দারে। এই বৃক্ষ দ্বারা ভাল ও মন্দের সূক্ষ্ম বিচার খুদে মহুয়ার সহিত তুল্যতা করে দেখানো হয়েছে। বুদ্ধির দৌড় আছে কিন্তু তাহা হৃদয় সঞ্জাত নয়। এইরূপ মানসিক বৃত্তি ধর্মের প্রতিকূল। উপরোক্ত সব আচার বা কর্ম দ্বারা সত্য বা ধর্ম লাভ হয় না। পেটের বা পেঁচানো পাটোয়ারি বুদ্ধি অসরলতার প্রতীক। ইহা অধর্ম। মন, মুখ ও কাজে এক রূপ তার নাম সত্য। সত্য সর্ব শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
শেষ বৃক্ষটি সারি সারজম দারে : সারি অর্থাৎ সৎ সত্য। সারজম—শাল দারে বৃক্ষ বা দ্রুম। এখানে সদ্ আচারই যে ধর্ম তাহা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। সারি সারজম বৃক্ষ সদাচারের প্রতীক। হিন্দু শাস্ত্রে আছে আচার প্রভাবঃ ধর্ম। সদাচার থেকে ধর্মের উৎপত্তি।
হিন্দু শাস্ত্রে একটি শ্লোক আছে যাহা সারি সারজম বৃক্ষের কথার সহিত মিলে যায়। শ্লোকটি হচ্ছে
“ধর্মহস্যমুলান্যসব প্রকাণ্ডো বিজ্ঞানি শাখাচ্ছদনানি কামা, যশাংসি পুষ্পানি ফলঞ্চ পুন্যৌ সদাচার তরু মহীয়ান”।
যার অর্থ হচ্ছে সদাচার তরুর মূল হচ্ছে ধর্ম, গুড়ি হচ্ছে আয়ু, শাখা হচ্ছে বিত্ত, পত্র হচ্ছে কামনা (সৎ কামনা), পুষ্প হচ্ছে যশ, এবং ফল হচ্ছে পুণ্য। অর্থাৎ সদাচার দ্বারা ধর্ম, আয়ু, বিত্ত, কাম, যশ ও পুণ্য লাভ হয়ে থাকে। ইংরেজিতেও আছে— Truth is like a vast true which yields more and more fruite, the more you nature it. There is no religion higher than truth.” আচারঃ পরমো ধর্মঃ। প্রণিধান যোগ্য।
প্রত্যেকটি বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গান আছে তাহা সূত্রের মত কাজ করে। এখানে দেওয়া গেল না। ত্রুটি রইল। এড়ে এবং আতনাঃ, লেপেচ এবং তেরেল ও সারি এবং সারজম এই তিনটি শব্দ অনুপ্রাস অলংকারে শোভিত। তাই উচ্চারণ অতি সুগম এবং স্মরণের রাখার অনুকূল। রূপক তো আছেই তা বলা বাহুল্য। গুরুদের সাহিত্য জ্ঞানের পরিচয় এখান থেকে আমরা পাচ্ছি।
বিস্তিটি শেষ হয়নি। সারি সারজম বৃক্ষের নিকট সত্য লাভ হল। এই শাল বৃক্ষের তলায় জাহের প্রতিষ্ঠা হল। সদাচার ভিত্তি করে বা সাত্বিক ভাবের সহায়ে তাঁরা “মাঁ মড়ে বঙ্গা” এবং “বাহা বঙ্গা”-র প্রবর্তন করলেন। বর্তমান কালেও সাঁওতালরা 'মাঁ মড়ে বঙ্গা' বা 'মাঃ মড়ে' পূজা এবং 'বাহা বঙ্গা' বা 'বাহা পরব' করে চলেছেন। মাঃ গুঁড়ে পূজার অর্থ করলে দাঁড়ায়, মাঃ অর্থে কাটা বা কর্তন করা এবং সঁড়ে পঞ্চ বা পাঁচ। এক সঙ্গে অর্থ করলে হয় পঞ্চ কর্তন পূজা। মাঃ মড়ে পূজাটিতে ইন্দ্রিয় জয়ের তাৎপর্য্য আছে। মাঃ মড়েঃ ইন্দ্রিয় জয়ের সাধনা। বাহা অর্থে ফুল এবং বঁগা অর্থে দেবতা। প্রকৃতি যখন বসন্ত কালে নানা রঙের ফুলেতে সেজে ওঠে তখন বাহা পূজার অনুষ্ঠান হয়। ফুল দিয়ে আমরা ঘর সাজাই, ফুল দিয়ে লোককে সম্মান দিই, ফুল প্রেমের, সৌন্দর্য্যের ও অনাবিল আনন্দের প্রতীক। ফুলের ব্যবহার সকলের নিকট সমান। সাঁওতালী শাস্ত্র অনুযায়ী ফুল আত্মার প্রতীক। 'জীইয়ি বঙ্গা বাহা লেকানা' বাহা বঙ্গাতে বাহা পূজায় আত্মদর্শনের ইঙ্গিত আছে। মাঃ মড়ে সাধনা। আত্ম দর্শনের সাধনা এবং বাহা বা ফুল হচ্ছে আত্মার প্রতীক। আত্মাই সত্য, আত্মাই ভগবান। সাধনের দ্বারা তাহা লাভ হয়। সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের ধর্মে আধ্যাত্মিকতা আছে ইহাই তার প্রমাণ। সাধনের দ্বারা ইন্দ্রিয় জয় কর, আত্মা ফুলকে (বাহাকে) লাভ করাই সাঁওতাল ধর্মের নিগূঢ় রহস্য। সাঁওতালরা মুর্তি পূজা করেন না। নিজেরাই পূজো করেন।
প্রকৃতির মাধ্যমে প্রকৃতির ক্রোড়ে লালিত হয়ে প্রকৃতি তথা ভগবানের পূজা সাঁওতালদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। ইহাই সাঁওতাল তথা আদিবাসী গুরুদের প্রবর্তন ও অবদান।
সাঁওতালরা কৃষি জীবি। চাষ-আবাদই তাঁদের প্রধান জীবিকা নির্বাহের উপায়। চাষ বা কৃষিকে কেন্দ্র করে তাদের নানা ধর্মীয় পূজা অনুষ্ঠান আছে। ‘এরঃ সিম' যা হলকর্ষণ বা বীজ বপনের আগে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এরপর ধান্য রোপন হলে, শস্য শ্যামল হয়ে উঠলে ‘হারিয়াড় সিম’হাড়িয়ার অর্থ সবুজ এবং বীজপুষ্ট হয়ে ধান পাকলে ধান কাটার আগে ‘জান থাড়' পূজা অনুষ্ঠান হয়। পূজায় বলি দেওয়া হয় এবং যাঁর শক্তিতে গোছ বেড়ে ওঠে, বীজ দানা বাঁধে তাঁর সহায় প্রার্থনা করা হয়। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ভক্তি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করা হয়।
প্রাচীন কালে ভারতে আরণ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেখানে গুরুরা অধ্যাত্ম বিদ্যা শিক্ষা দিতেন। তপোবনে অধ্যাত্ম চর্চা হতো। বেদ পাঠ হত। ছাত্র বা শিষ্যরা গুরু সন্নিধানে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি করতেন। বিদেশী পণ্ডিতরা তপোবনকে ফরেস্ট ইউনিভারসিটি বলেন।
আদিবাসীদের ধর্মের কথায় বনের কথা আছে। বনের বৃক্ষ দ্বারা মনের কথা মনের বৃত্তি বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতি থেকে দৃষ্টান্ত চয়ন করে, চাক্ষুষ করে তাঁদের ধর্মীয় উপলব্ধি বা জ্ঞান প্রকৃতির বস্তু সাহায্যেই প্রকাশ করা হয়েছে। বনের গাছের এক একটা দৃষ্টান্ত যেন এক একটা লিখিত লিপি। কেন না এখনও তাদের পুরাণ কাহিনী ঐ দৃষ্টান্ত সহায়ে বোধগম্য হচ্ছে এবং জীবন্ত আছে। প্রশ্ন জাগে তাই কাদের Forest University ছিল। আদিবাসী সাঁওতালরা কি প্রাক্ বৈদিকতার অধিকারী?
বিন্তির শুরুতে বলা হয়েছে দুঃখ পেয়ে, দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করে গুরুরা দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য ধর্মের সন্ধান করেছেন। তাই বিন্তি অনুযায়ী আদিবাসী গুরুরা ছিলেন বিষাদ যোগী। তারা দুঃখে দুঃখী হয়ে দুঃখ দূর করার চিন্তা তাঁদের মনে উদয় হয়েছিল। বাটি গুরু, গাঁড়ো গুরু, সিদ-অ গুরু, সিধ-অ গুরু, রহড় গুরু ও কামরু গুরু নামে তাঁদের নাম আমরা শুনে আসছি। তাঁদের নাম শুনেই তাঁদের সম্বন্ধে কিছু জানতে পারি। বাটি গুরু তাঁর হাত সর্বদা একটা বাটি থাকত। গাড়ো গুরু তিনি সর্বদাই আসনে আসীন থাকতেন পদ্মাসন ইত্যাদি। সিদ-অ গুরু বা সিধ-অ গুরু তাঁরা সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। রহড় গুরু-রহড় অর্থে শুকনো। তাঁরা অস্থি চর্ম সার শুকনো দেহ। যোগী গুরুদের বাহা শরীর এরূপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই সব বাহ্যিক চেহারা দেখে বাহ্যিক ভাবে চেনা হত। কিন্তু তারা ছিলেন যোগী। এনাদের আমরা দাঁসায় পরবে বা দুর্গা পূজার সময় অঁড়হে স্তব-স্তুতি করতে দেখি। আমরা দুঃখে হায় হায় বলে বিলাপ করি। হায় হায় দুঃখের সূচক বা দ্যোতনা। হায় হায় শব্দ উচ্চারণ করে গুরুর নাম ধরে, ধরম গুরু, ধরম চেলা ইত্যাদি বলে তাদের স্তুতি করা হয়। গুরুর স্তবের রীতি ইহাই যাহা সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত। এই রীতি আমার মনে হয় পৃথিবীতে কোথাও নেই। গুরুবাদ থাকতে পারে। কিন্তু রীতি নেই।
তিনিই গুরু যিনি জ্ঞান দেন। যিনি আত্ম জ্ঞান দেন। যিনি শিষ্যকে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ করেন। তিনিই গুরু আবার এক অর্থে ভগবানও গুরু। ভগবানের উপর গুরু আর কেউ নেই। গুরুর স্তব-স্তুতির গান অনেক আছে। স্থানাভাবে এখানে দেওয়া গেল না।
প্রাচীন পুরাণ বিন্তিতে আমরা দুঃখের গান পাই যা সাঁওতালরা এখনও গেয়ে আসছেন। বহু প্রাচীন গান :-
(১) অত জানাম লেন
ধুবি ঘাঁস জানাম লেন,
মানমী জানাম লেন
দুখ হঁ জানাম লেন।
কাঁসা পিতল জানাম লেন
আচুর বিহুর জানাম লেন।
মানসী জানাম লেন রাঃ জং জানাম লেন।”
গানের অর্থ ঃ পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল, দুর্বা ঘাসও জন্মে ছিল। মানুষ জন্মে ছিল তার সঙ্গে দুঃখও জন্মে ছিল। কাঁসা পিতলের যেমন বার বার জন্ম হয় বা তৈরী হয় সেইরূপ মানুষের বার বার জন্ম নিতে হয় এবং দুঃখও বার বার ভোগ করতে হয়। মানুষের জন্ম দুঃখ ভোগের জন্য বা ক্রন্দনের জন্য।
(২) জ্বালা পুরি, জ্বালা পুরি ক মেনা জ্বালা পুরি দ, তিমিন ন সাগিঞ।
হেম আন খান গে, হবর আন খানগে জ্বালা পুরি দ জাঁগা ফেডরে।”
অর্থ : ইহা বহু প্রচলিত গান। জ্বালা পুরি জ্বালা পুরি (দুঃখের পুরি) সবাই বলে। জ্বালা পুরি কোথায় কত দূরে? কোলে নিলে কাঁখে নিলে পায়ের তলাতেই জ্বালা পুরি। অর্থাৎ নিকটে নিজের কাছেই।
(৩) হায় হায় জ্বালা পুরি রে হায় হায় জ্বালা পুরি রে হায় হায় মানমী জানাম লেনা হায় হায় অকারেঞ দহ কিন
হায় হায় মানমী জ্বালা পুরিরে।
অর্থ : ইহা সৃষ্টির প্রথম লগ্নের গান। হায় হায় এই জলে, এই জল পুরিতে
মানুষের জন্ম। হায়! হায়! কোথায় রাখব এই দুই মানুষকে। (হাঁস ডিম থেকে জন্ম আদি মানব আদি মানবীকে) হায়! হায়! এই জলে এই জল পুরিতে। হায়! হায়! এই জ্বালা পুরিতে। কোথায় রাখব হায়! হায়! এই মানুষ দুটিকে। খুব কাব্য করে গানগুলি মুখে মুখে রচিত।
ভারতের বৈদিক হিন্দু ঋষিরা দুঃখবাদ প্রচার করেছেন। তাঁরা জীবনে দুঃখ আছে স্বীকার করে নিবৃত্তির উপায় নির্দেশক শাস্ত্র রচনা করেছেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের বিষাদে আচ্ছন্ন হওয়ার সময়ই গীতার উপদেশ প্রদান করেছেন।
বৌদ্ধ দর্শনেও দুঃখবাদ বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। প্রত্যেক মানব জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর অধীন। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত নিরন্তর দুঃখ ভোগ করে। মানুষের জ্বালা, যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট, শোক, তাপ, নিরাশা, হতাশা ইত্যাদি কষ্টের সীমা নাই। কামনার অপুরণে দুঃখ, পূরণেও শান্তি নেই। মানুষ অবিরত দুঃখ ভোগ করে। সংসারে যে সুখ ভোগ করে তাহা ক্ষণিক এবং সুখে আশ্রয়ও নেই। বেদের উপাসনা মন্ত্রেও দুঃখ নিবৃত্তির কথা আছে।
0 Reviews