সাঁওতাল সভ্যতায় কারাম

সাঁওতাল সভ্যতায় কারাম

Size

Read more

 

সাঁওতাল সভ্যতায় কারাম 






সাঁওতাল সভ্যতার বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে কারাম একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। সাঁওতাল সভ্যতায় বিভিন্ন ধরনের 'কারাম' উৎসবের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন ‘ডাঙ্গুয়া কারাম’, ‘গুরু কারাম', 'চেলা কারাম', 'মাঝি কারাম', 'বাহা কারাম', 'মাঃ মঁড়ে কারাম’, ‘জেওয়েদ কারাম’, ‘উপাস' বা 'জানাম কারাম'। এই জানাম বা উপাস কারাম অনুষ্ঠিত হয় যখন কারো ব্যক্তিগত জায়গায় বা বাড়ীতে কারাম গাছ জন্মায়। কথিত আছে কার্ম ও ধার্ম (যমজ সন্তান) সাঁওতাল সমাজে 'কারাম' পূজার প্রথম প্রবর্তক। ‘কারাম গশায়’(ঠাকুর)-কে সাঁওতালেরা তাদের ধনসম্পত্তির দেবতা হিসাবে মনে করেন। কারণ কার্য ও ধার্ম কারাম গশায়কে সেবা করেই সম্পদশালী হয়েছিলেন।

আমার মনে হয়, কার্য ও ধার্ম শব্দ দুটি কর্ম ও ধর্মের অপভ্রংশরূপ, যাহা সাঁওতালদের পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ধারনা থেকে গ্রহণ করেছেন। এবং এই কারাম পূজা সাঁওতালদের মধ্যে অনেক পরে প্রচলিত হয়েছে, যখন তাঁরা পশু পালন শুরু করে কৃষি নির্ভর জীবন যাপন করতে শিখলেন। কারণ সাঁওতালদের দেবতাদের একটি তালিকা রয়েছে শ্রদ্ধেয় L. O. Skrefsurd সাহেবের লেখা "HOR KO REN MARE HAPRAM KO REAK KATHA" (1887) পুস্তকে। সেখানে কারাম দেবতার নাম তালিকাভুক্ত নাই। কারাম পুজোর পর 'কারাম-কে নদী বা পুকুরের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই পুজোর বিসর্জন দেওয়া হিন্দু রীতিতেই প্রচলিত। কিন্তু সাঁওতাল সভ্যতায় কারাম ব্যতীত কোন পুজোর পর বিসর্জন দেওয়ার রীতি নেই।

কিন্তু একটা জিনিষ এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি যে, যদিও সাঁওতালদের পূর্বপুরুষেরা কার্ম ও ধার্ম শব্দ দুটি হিন্দু ধারনা কর্ম ও ধর্ম থেকে নিলেও এই ধারনাটি তাঁরা তাঁদের নিজের মত করে নিয়েছেন। কেন-না 'কারাম বিন্তি' বলছে যে কার্ম ও ধার্ম হচ্ছে হাঁসদা বংশের সন্তান।

সুতরাং যদি সাঁওতালদের পূর্ব পুরুষেরা 'কারাম গশীয়'-কে তাদের ধনসম্পত্তির দেবতা বলে মনে করে থাকেন, তবে সহজেই অনুমেয় যে তাঁহারা কর্মকেই দেবতা রূপে পুজো করছেন, এবং এখানে তাঁদের জীবন দর্শনের একটা দিক ফুটে উঠেছে, সেটা হচ্ছে তাঁরা মনে করেন 'কর্মই সম্পদ'। কেবল কর্মই তাঁদেরকে শক্তিশালী করতে পারে।

কার্ম ও ধার্ম কর্তৃক কারাম পূজা প্রবর্তনের পর, ধার্ম কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেছেন। কেবল কার্ম অর্থাৎ কর্মই বিদ্যমান এবং তিনিই 'কারাম গশায়’, যিনি তাঁদের ধনসম্পত্তির দেবতা। সুতরাং কর্মই তাঁদের কাছে শ্রদ্ধেয় কিন্তু ধর্ম নয়। তাঁদের জীবন দর্শন অনুসারে যেখানে কর্ম সেখানেই ধর্ম এবং কর্মের মাধ্যমেই ধর্মকে অর্জন করা যায়। সেই জন্যই তাঁরা ধর্ম অপেক্ষা কর্মকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু সাঁওতালরা প্রকৃতির পূজারী, সেইহেতু তাঁরা কারাম গশায়-এর প্রতীক হিসাবে একটি গাছকে নিলেন যেটা 'কারাম' গাছ নামে পরিচিত হলো।

আমার উপরোক্ত বিবৃতির যুক্তি আমি নিচের একটি আলোচনার মধ্য দিয়ে আপনাদের কাছে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি—

মাঝি রামদাস টুডু রেস্কা তাঁর সুনামধন্য পুস্তক “খেরওয়াল বংশা ধরম পুথি”- তে উল্লেখ করেছেন যে—একদিন ধার্ম ভিক্ষা শেষে বাড়ী ফেরার পথে টাটিঝারি নদীর তীরে একটি কদম গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

তখন ‘করম গশায়’ তাঁকে স্বপ্নে বললেন— “এজা বাবু ধার্ম কারাম বিদ মে, কারাম সাকাম রেয়াঃ তুমদাঃ বেনাও মে, আর পে ধাও গড মে, আর পে ধাও জোহার মে, আর এনেচ আচর মে। কাদাম দারে বুটা গাড়া ধারে রে মিদটাং ধেনু-গাই মেনায়া আর অনা ধীরি চাটানী শিরোম চাউরারে মিদটাং দাহড়ী লুগড়ী মেনাঃ আ। আর অনা গাড়া ধারে ডুংরী মাৎ ঝাড় ঠেন মিটাং গাঙ্গি ত্ৰিয়ো মেনাঃ আ, অনাকো ইদি মে। তিনীঃ এম কয় বাড়ায়া ঝতওয়াঃ ইঞ এমামা, দিন হিলঃ নওয়া গাড়া ধারেতে কারাম বিদ মে আর ইঞ এমামা।” (তৃতীয় প্রকাশন-১৯৯৪, পৃষ্ঠা-৭৩) অর্থাৎ—

“ও বৎস তুমি কারাম রোপন কর, কারাম পাতা দিয়ে মাদল তৈরী কর, তিনবার প্রণাম কর আর তার চতুর্দিকে নৃত্য কর। নদীর তীরে কদম গাছের নীচে একটি ধেনু- গাই রয়েছে, শিরম ঝোপের নিকটস্থ প্রস্তরফলকে একটি পাগড়ী বাঁধার কাপড় রয়েছে আর নদীর তীরবর্তী ছোট পাহাড়ের বাঁশ বনে একটি বাঁশি রয়েছে। এগুলোকে তুমি নিয়ে যাও। তুমি কত দিন এইভাবে ভিক্ষা করবে, আমি তোমাকে সব দেব। তুমি প্রতিদিন এই নদীর তীরে কারাম রোপন কর, আমি তোমাকে আরও দেব।”

উপরোক্ত এই কথাগুলো থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে, 'কারাম গশায়' ধার্মকে ভিক্ষা ছেড়ে 'কারাম বিদ' অর্থাৎ কর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন, কর্মের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করতে বলেছেন। কর্মের উৎস হিসাবে তিনি তাকে গাই-বাছুর দিয়েছেন এবং প্রতিদিন নদীর তীরে গাই-বাছুর নিয়ে চরানোর কাজ করতে বলেছেন। কারাম গশায়-এর বক্তব্য অনুসারে ভিক্ষা করে দুঃখ কখনো দূর হয় না, কর্মের মাধ্যমেই সুখ-শান্তি ফেরানো সম্ভব। আমরা 'কারাম বিত্তি' থেকে জানতে পারি যে কার্ম ও ধার্ম কর্মের মধ্য দিয়েই প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হয়। আবার আমরা দেখতে পাই 'কারাম গশায়' ধাকে মাথার পাগড়ী বাঁধার কাপড় ও বাঁশী দিয়েছিলেন। এই দুটোই কঠোর পরিশ্রম সহায়ক। কারণ কাজ করার সময় পাগড়ী প্রখর রৌদ্র থেকে মাথাকে রক্ষা করে এবং বিশ্রাম নেওয়ার সময় বাঁশির মধুর সুরেলা ধবনি শরীরের ক্লান্তিকে দূর করে। নৃত্য-গীত কঠোর শ্রম জীবনে চিত্তবিনোদনের জন্য খুবই প্রয়োজন এবং সেই জন্যই বোধহয় সাঁওতালরা নৃত্য-গীত প্রিয় লোক, কেন না তাদের কর্মের প্রতি অগাধ ভক্তি।

কিন্তু বর্তমান সাঁওতাল সমাজের কারাম গুরু বা তাঁদের অজান্তে 'কারাম গর্শায়'- কে হিন্দু সমাজের লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে এক করে দেখা শুরু করেছেন। কারণ লক্ষ্মীদেবীও নাকি সমাজের ধন সম্পত্তির দেবী। 'কারাম গশায়' হচ্ছে সাঁওতাল সমাজের পুরুষ দেবতা এবং লক্ষ্মী হচ্ছে হিন্দু সমাজের নারী দেবী। বর্তমান কারাম গুরুরা এতটাই হিন্দু প্রভাবিত যে তাঁদের পুরুষ দেবতাকেও নারী হিসাবে কল্পনা করতে দ্বিধা করছেন না। এর প্রমাণ হিসাবে আমি দুটি পুস্তকের কথা উল্লেখ করছি। প্রথমতঃ মাঝি রামদাস টুডু রেস্কার “খেরওয়াল বংশ ধরম পুথি”-র উল্লেখ করছি। তিনি তাঁর পুস্তকে কারাম গশায়'-কে নারী রূপে চিত্রিত করেছেন। 'কারাম গশায়' শষ্য মঞ্জুরী ডান হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। (পৃষ্ঠা নং ৭২, চিত্র নং ২২) আবার রামদাস টুডু রেস্কা কারাম গশীয়- কে মাতা বলে সম্বোধন করেছেন এইরূপ—

কারময়ো চেতে লাগিদ এম বাগিয়াদ লিঞ, কারাময়ো চেতে লগিদ এম উষাদ এন; কারাময়ো কারাম গাঁশায়। (পৃঃ সং ১৪)

অর্থাৎ, কারাম জননী তুমি কেন আমাদের ত্যাগ করলে, কারাম জননী কেন তুমি অভিমান করলে, কারাম জননী কারাম ঠাকুর।

দ্বিতীয় : গুরু কানাই লাল টুডুর কারাম বিন্তী পুস্তকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি তাঁর উক্ত পুস্তক মলাটে কারাম গাঁশায়কে নারী রূপেই চিত্রিত করেছেন। আবার তিনি উল্লেখ করেছেন—

হিসি (নিসি) হিসি য়ো হিসি

আম লাগিদ গে য়ো হিসি

গেল সেরমা লিঞ উপাস আকাদ

ইসি সেরমা লিঞ তিরাস আকান দ। (পৃঃ সং ৫৩)

অর্থাৎ— হিসি হিসি মা হিসি

• তোমার জন্যই মা হিসি

দশ বৎসর কাল পানীয় হীন হয়েছি।

আবার তিনি তাঁর উপরোক্ত পুস্তকে উল্লেখ করেছেন-

সাসাং সুনুম লিঞ আজঃ মেয়া

সামাং শাড়ী লিঞ বাঁদে মেয়া

এনই ঠাকুর ইদিম গেয়া লিঞ আলিঞা দিশম তে। (পৃ সং-৫৩)

অর্থাৎ—

তেল হলুদ তোমাকে মাখাবো

হলুদ শাড়ী পরাবো

তবুও ঠাকুর

আমরা নিয়ে যাবো তোমাকে আমাদের দেশে।

এখানে ‘কারাম গাঁশায়' কে নারী রূপে কল্পনা করা হয়েছে বলেই শাড়ী পরানোর কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু তিনি কয়েকজন কারাম গুরুর নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর পুস্তকে। তাঁদের মধ্যে লালমোহন টুডু (উড়িষ্যা) এর একটি গানে বলা হয়েছে—

করম করম করম গঁশায়

আপন করম বাহির দশা

করম করে মায় গো

কপালের হীন। (পৃঃ সং ৪৩)

অর্থাৎ— হে করম ঠাকুর, আমরা নিজ কর্মফলেই গৃহ ছাড়া হয়েছি। আমাদের কর্ম দোষেই মা গো আমরা ভাগ্যহীন হয়েছি।

লি আমি মেদিনীপুর জেলা এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার বেশ কয়েকজন কারাম গুরুর মুখে বিস্তি শুনেছি। তারা অধিকাংশই ‘কারাম গঁশায়’ কে দেবী হিসাবেই কল্পনা করেছেন এবং তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে হিন্দু সমাজের লক্ষ্মী দেবীর দিকে।

আবার আর এক জন কারাম গুরুর মুখে সম্প্রতি কারাম বিন্তি শুনলাম আমি আমার গবেষণার কাজে গিয়ে। তিনি হচ্ছেন গুরু শুকলাল বাস্কে। তিনি বোলপুর মহকুমার খ্যাতিমান ‘কারাম গুরু'। তিনি তাঁর বিত্তিকে 'কারাম গঁশায়' এর পরিবর্তে 'কারাম লুখি' বলে উল্লেখ করলেন। আমার মনে হয় 'লুখি' শব্দটি লক্ষ্মীরই অপভ্রংশ রূপ।













0 Reviews