Read more
আলস্য ছাড়ার উপায় এবং কর্মস্পৃহা সম্পর্কে গীতা
আলস্যবোধ আপাত সুখকর কিন্তু পরিণামে বিড়ম্বনার কারণ। জরুরি কাজ ফেলে রাখার ফলে মনস্তাপে ভুগতে হয়। অনেকেরই এই অভিজ্ঞতা। কিন্তু আলস্যের কারণ কী? দৈহিক স্থূলতা কিংবা বিশ্রামের অভাব বা ক্ষুধা- তৃষ্ণা আলস্যের কারণ হতে পারে। কিন্তু দৈহিক চাহিদা পূরণের পরও অনেক সময় কিছু করতে মন চায় না, চুপচাপ শুয়ে কিংবা বসে থাকতে ইচ্ছে করে। দেখা যায়, যথেষ্ট বিশ্রামের পরও আলস্য গ্রাস করে। আবার, কেউ সবসময় সতেজ, প্রচুর কাজ করেন। আসলে আলস্যবোধ মূলত মানসিক বিকার; মনের রোগ। এই রোগে অনেকেই বেশি আক্রান্ত থাকেন সকালবেলায়। জরুরি কাজ থাকলেও বিছানা ছাড়তে মন চায় না। মনে হয়, আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি! তাপ যেহেতু এটি মনের রোগ তাই মনকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে—এমন দাওয়াই-ই দরকার। এক্ষেত্রে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তুলনাহীন। গীতার বাছাই করা কয়েকটি শ্লোকের স্মরণ-মনন আলস্য ত্যাগ ও কর্তব্যকর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করবেই। যেমন, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকটি। স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত প্রিয় এটি। তমোগুণে আচ্ছন্ন অর্জুন দুর্বলতার শিকার। নিজের কর্তব্যকর্ম ভুলেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে ক্ষাত্রধর্ম পালনে অনীহা। তখনি শ্রীকৃষ্ণ কঠিনভাবে অর্জুনকে বলছেন : 'ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’–এই ক্লীবভাব, কাপুরুষতা আশ্রয় করো না। ‘নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে’–এই দুর্বলতা তোমার শোভা পায় না। আমরাও যখন তমোগুণে আচ্ছন্ন হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে চাই না, কর্তব্য-অকর্তব্য ভুলে যাই, তখনি এই শ্লোকটির অর্থসহ আবৃত্তি মনোজগতে নিবেদিতা চেয়ার প্রফেসর, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক ব্যাপক পরিবর্তন আনে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন: “এই একটি শ্লোক পড়িলেই সমগ্র গীতাপাঠের ফল পাওয়া যায়...।”
প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। বেশ কয়েক দশক আগের সত্য ঘটনা। রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত এক আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আমেরিকার নিউ ইয়র্কে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার। এক রাতে শহরতলির বহুতল বাড়িতে রোগী দেখে নিচে নেমে এলেন। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখেন, চারজন দুষ্কৃতকারী গাড়িটি ঘিরে ফেলেছে, ডাক্তারকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে নির্দেশ দিচ্ছে। চারজনের হাতেই বেসবল ব্যাট। ভয় ও আতঙ্কে ডাক্তার ঘামতে শুরু করেছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। হঠাৎ তাঁর অবচেতন স্তর থেকে উঠে এল গীতার সেই বলপ্রদ শ্লোকটি— 'ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ...'। মিশনের এই প্রাক্তন ছাত্রটি মনে বল ফিরে পেলেন, শান্তচিত্তে স্থিরসিদ্ধান্ত নিলেন। গাড়ি থেকে নামার ভান করে টপ গিয়ারে গাড়ি চালিয়ে ওদের নাগালের বাইরে চলে গেলেন।
প্রাক্তন ছাত্রসম্মেলনে এই ঘটনাটির উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন—যখন তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র, এক সন্ন্যাসী গীতার কয়েকটি শ্লোক মুখস্থ করিয়েছিলেন, অর্থ- সহ। শ্লোকগুলির মধ্যে দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই শ্লোকটি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তিনি নিজেকে উদ্দীপিত করতেন শ্লোকটি আবৃত্তি করে। আসলে, আমাদের প্রত্যেকটি চিন্তা চিত্তের ওপর একটি সংস্কার বা ছাপ রেখে যায়, যা আমাদের অজ্ঞাতসারে কাজ করে। অবচেতন স্তরে চুপটি করে বসে থাকা এই সংস্কার উদ্দীপক কিছু পেলেই আত্মপ্রকাশ করে। প্রয়োজনের সময় ডাক্তারকে এইভাবে ভাল লাগা শ্লোকটি সাহায্য করল।
জন্য। শিক্ষিকা বিরক্তি সহকারে বললেন : “আমার শরীর ভাল নেই, বাড়ি যেতেই হবে।” বাড়ি ফিরে ছেলেকে যাই হোক, গীতার এই একটি শ্লোকই আমাদের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সজাগ রাখতে পারে, বেচালে পা পড়তে দেবে না। যখনি কোনোরকম দুর্বলতা, অলসতা বা আবিলতা মনকে গ্রাস করতে উদ্যত, তখনি ‘নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে’-এ তোমার শোভা পায় না—মন্ত্রের মতো কাজ করতে পারে। মনে ধিক্কার আসে—একি,
ডাকলেন। ছেলে তখন ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়েই শিক্ষিকা-মা ছেলের হোম টাস্ক করতে বসলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক।
এখন প্রশ্ন, যিনি স্কুলে ক্লান্তির অজুহাতে এক রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অনুরাগী হয়ে এ আমি কী করছি! ঘন্টা বাড়তি সময় দিতে নারাজ, তিনিই পরম যত্নে আসলে আমাদের যেকোনো দুর্বলতা-অলসতা ছেলেকে পড়াতে বসলেন কীভাবে? আসলে, স্কুলে বা আবিলতার কারণ ক্ষুদ্র দৈহিক অস্তিত্বকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার প্রবণতা। গীতা আমাদের গভীরতর অস্তিত্বের সন্ধান দেয়। সেই অস্তিত্ব যেকোনো বাধা-বিঘ্ন ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। সেই অস্তিত্বকে কোনো অস্ত্র আঘাত করতে পারে না, আগুন পোড়াতে পারে না—‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈন্যং দহতি পাবকঃ”। ব্যক্তিকে নির্ভীক করে। অবিচলিত থাকতে পারে সে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর স্বরূপের সন্ধান দিয়েই মনের বিষাদ বা দুর্বলতা দূর করতে পেরেছিলেন। অর্জুনও শ্রেয় ও কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিলেন। একইভাবে আমরাও অর্জুনের মতোই লাভবান হতে পারি—যদি আমাদের স্বরূপের মনন করি। বস্তুত, স্বামীজীর নির্দেশ—“তুই সৰ্বগ আত্মা—এটিই মনন ও ধ্যান করবি।” তাহলে কী হবে? একজন ছাত্র আরো ভাল ছাত্র হবে, একজন শিক্ষক আরো ভাল শিক্ষক হবেন। নিজের কর্তব্যপালনে প্রত্যেকেই তৎপর ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবেন। কর্মোন্মাদনা দেখা দেবে।
প্রসঙ্গক্রমে এক বয়োজ্যেষ্ঠ দাদার কথা মনে পড়ল। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাত্রে শোওয়ার আগে একবারও তিনি বিছানা স্পর্শ করেন না। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ৬৯ ছুঁই-ছুই। বিভিন্ন সমাজকল্যাণ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। নিঃস্বার্থ সেবায় আনন্দ পান। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের রহস্য তাঁর অন্তঃশক্তি। ক্ষুদ্র দৈহিক সত্তার ওপরে উঠতে পারেন তিনি। ফলে, জাগতিক কিছু প্রাপ্তির আশায় তাঁর কর্ম অশুদ্ধ নয়। হাসিমুখে পরহিতে শ্রমদান করতে পারেন।
অন্যদিকে, সরকারি স্কুলের এক শিক্ষিকা-চারটি পিরিয়ড নিয়েছেন, অপেক্ষা করছেন স্কুলের শেষ ঘণ্টার জন্য। এমন সময় প্রধানশিক্ষিকা তাকে অনুরোধ করলেন ছাত্রীদের ড্রামা রিহার্সালে ঘন্টাখানেক থাকার তিনি চাকরি করেন। ফল চাওয়া কর্মের নাম চাকরি। চাকরিতে মাইনের বিনিময়ে কর্ম, কর্মের জন্য কর্ম নয়। কাজটি ভিতর থেকে কোনো প্রেরণা জোগাচ্ছে না। তাই ডিউটির বাইরের কাজে বিরক্তি। অথচ নিজের সন্তানের জন্য যেকোনো পরিশ্রমই তৃপ্তির। শিক্ষিকা তাঁর ছোট্ট অস্তিত্ব ধরেই বেঁচে থাকতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে সেই অস্তিত্ব নিজের পুত্র-কন্যা ও স্বামী। কিন্তু পরিবর্তনশীল ও ক্ষণভঙ্গুর অস্তিত্বকে সম্বল করলে পরিণামে হতাশা ও দুঃখই বরণ করতে হয় মাকে। এমনটিই দেখা যায়। সন্তানের কাছে মায়ের প্রত্যাশায় আঘাত লাগলে ফল- চাওয়া কর্মের ইতি (‘আমি ওর জন্য এত করলুম, শেষে কি না...')! আসলে স্বার্থবুদ্ধিতে কর্মের পরিণতি দুঃখ ও হতাশাই হয়। বেশির ভাগ মানুষেরই এই অভিজ্ঞতা।
গীতা কর্মের কৌশল জানিয়ে দিয়েছে। যিনি অর্থ বা অন্য কোনোপ্রকার অভিসন্ধি ত্যাগ করে কাজ করতে পারেন, তিনিই যথার্থ কর্ম করেন। স্বার্থ নেই, আসক্তি নেই, ফলে হতাশাও নেই। কর্ম তো করতেই হবে, না করে কেউ থাকতে পারে না। গীতার ৩য় অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকে স্পষ্ট করে বলা আছে : ‘ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ'—কেউ কখনো অল্পক্ষণও কর্ম না করে থাকতেই পারে না। সে-কাজ হাত-পা নেড়েই হোক বা কথা বলেই হোক। আসলে কায়, মন ও বাক্যে কোনো না কোনোভাবে আমরা কাজ করতে বাধ্য হই। আমাদের প্রকৃতিই তাই। চুপচাপ বসে থাকলেও আমরা যে চিন্তা করছি, সেটাও কর্ম। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কর্ম আমাদের ক্লান্ত করে। আমরা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি রবিবারের জন্য। তাছাড়া, কর্ম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্গতিরও কারণ হয়। কেন এরকম হয়? গাভার উত্তর- আত্মকেন্দ্রিকতা,
স্বার্থপরতা ও সকাম কর্ম। তাহলে আমাদের কী করতে হবে? গীতার মতে, কর্মযোগ। ‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।' (২।৫০) কৌশলপূর্বক কর্মই কর্মযোগ। ' কৌশল, মানে চালাকি নয়। Efficiently ও Scientifically কর্ম করা। অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম। কেন নিষ্কাম কর্ম করব? কর্ম যদি কামনা-বাসনায় তাড়িত না হয়, তাহলে সবচেয়ে সুচারুরূপে করা যায়। শান্ত মন নিয়ে করা যায়। শাস্ত মনে করা কর্ম অনেক বেশি productive হয়। তাছাড়া, নিঃস্বার্থ কর্ম বা সেবায় বাস্তবিকই দেখা যায়, এতে নিজেরই উপকার। সার্বিক উপকার।
এবার প্রশ্ন : আমরা কীভাবে কর্মযোগের অনুশীলন করতে পারি?
প্রথমত, যখন যা করব, পুরো মন দিয়ে করতে হবে। পুরো মন দিয়ে করলে কী হবে? মনের চঞ্চলতা দূর হবে। মনের চঞ্চলতা দূর হলে চিত্তশুদ্ধি হবে। আর চিত্তশুদ্ধি হলে কী হবে?—আমাদের অন্তর্নিহিত অনন্ত শক্তির বিকাশ হবে। অন্তর্নিহিত দেবত্ব প্রকাশিত হবে।
তাছাড়া এই যে দৃশ্যমান, পরিবর্তনশীল জগতের পিছনে এক, অদ্বিতীয় সত্তা আছে তা প্রকাশিত হবে। তখন কেবলই আনন্দ ও আনন্দ। কোনো দুঃখ-যন্ত্রণা কাবু করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, স্বামীজীর ভাষায় "Work through freedom Work through love!” স্বাধীনভাবে কাজের মাধ্যমে ভালবাসা আসবে কিন্তু আসক্তি আসবে না কাজে। কাজের গুণগত মান অনেক উন্নত হবে যদি তা ভালবাসার রসে সিঞ্চিত হয়, টাকার রসে নয়, মান- যশের প্রত্যাশায় নয়।
তৃতীয়ত, কোনো ব্যক্তির প্রতি সেবাকর্মে প্রত্যাশা বা প্রতিদানের আশা তো থাকবেই না, পরন্তু ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৩০নং শ্লোকটিকে স্মরণ করে সেই ব্যক্তির মধ্যে পরমেশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করতে পারি। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক, কিংবদন্তি কর্মযোগী স্বামী সারদানন্দজীর এই শ্লোকটি অত্যন্ত প্রিয় ছিল। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়—কীভাবে তিনি সমদৃষ্টিতে কাজ করেন, কীভাবে তিনি সবাইকে নিঃস্বার্থ ভালবাসা দান করেন? উত্তরে তিনি আবৃত্তি করেন। 'যো মাং পশ্যতি... স চ মে ন প্রণাশক্তি।'
আরেকটা কথা—‘সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরমা' (১৩/২৮) স্বামীজীর প্রিয় শ্লোক- অবিভক্তং চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম।' (১৩।১৭) অর্থাৎ ব্রহ্ম অপরিচ্ছিন্ন হয়েও সর্বভূতে বিভক্তরূপে প্রতীত হন—এই বোধে জারিত হলে অস্তর এতদূর ভালবাসা ও সহ-অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হয় যে, জগতের হিত নিজেরই হিত মনে হয়।
0 Reviews