Read more
শিল্পে ভারতীয় অবদান
স্বচ্ছতার দুই প্রতীক—জল ও কাচ। একটি তরল অপরটি কঠিন হলেও দুটিতে মিল অনেক। দুটিই অনিয়তাকার বা নির্দিষ্ট আকারশূন্য; পরিবেশ ও অবস্থা অনুযায়ী খাপ খাওয়ানোতে সক্ষম। প্রথমটি তরল হওয়ায় ক্ষেত্র অনুযায়ী আকার ধারণ করতে পারে, আর দ্বিতীয়টি কঠিন হওয়ায় তাকে যেকোনো রকমের আকৃতি প্রদান করা যেতে পারে। সর্বোপরি দুটিই স্বচ্ছ। আমাদের বর্তমান চর্চার লক্ষ্য দ্বিতীয় পদার্থটি কাচ। কারণ, স্বচ্ছতার উৎকৃষ্ট প্রতীক হলেও কাচ বিষয়ে সাধারণের জ্ঞান কিন্তু মোটেই স্বচ্ছ নয়। আর শুধু সাধারণ কেন, গুণিজন মহলেও বিষয়টি সহজ সরল অবস্থায় নেই। দেখা যায়, বিগত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞানী মহলে ঝাড়াই- বাছাই করেও কাচের ২২টি সংজ্ঞা প্রস্তাবিত হয়েছে, যার আধুনিকতমটি বলছে: “Glass is an amorphous solid which exhibits glass transition temperature by arresting the kinetics below supercooled liquid region when bypassed crystallization.
যাই হোক, আধুনিক পৃথিবীতে কাচ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে এবং নিত্যব্যবহার্য বস্তুসকল থেকে প্রযুক্তির সূক্ষ্ম প্রয়োগে এমনকী মহাকাশ গবেষণাতেও তা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের পথচলা কাচের ইতিহাস নিয়ে। কবে এবং কীভাবে প্রথম কাচের আবিষ্কার এবং মানুষই বা কবে থেকে ব্যবহার করতে শিখল তা কিন্তু আজও কাচের মতো স্বচ্ছ নয়। তবে এটুকু বোঝা যায়, এর প্রথম আত্মপ্রকাশ প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলের যেসমস্ত পদার্থ উঠে আসে গলিত লাভারূপে, তা ঠাণ্ডা হলে তার
মধ্যে অনেক কিছুর সঙ্গে একধরনের কালো কাচতুল্য পদার্থও থাকে (obsidian)। সম্ভবত সেটাই প্রথম প্রাকৃতিক কাচের আত্মপ্রকাশ। উক্ত পদার্থ থেকে একধরনের বোতলও তৈরি হয়। অনুমেয় যে, প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর মানবকুলও একে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করত। কিন্তু চলতি যে যে সভ্যতা পরম্পরার আমার উত্তরসূরি, তার পূর্বসূরিদের মধ্যে কারা প্রথম এর ব্যবহার শুরু করে—এবিষয়টা অস্বচ্ছ।
প্রচলিত ধারণা থেকে জানা যাচ্ছে, সিরিয়াতে কাচ তৈরির সময়কাল ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ; মিশরে ১৫৫১-১৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ; চীনে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশপাশে, অ্যাসিরীয়া বা মেসোপটেমিয়াতে ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্ববর্তী কোনো সময়ে। তাহলে প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে মেসোপটেমিয়া ও তৎসংলগ্ন, যেমন সিরিয়া অঞ্চলেই কাচ প্রস্তুতি ও তার ব্যবহার শুরু হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—ভারতীয় সভ্যতায় এবিষয়ে কীরকম ক্রিয়াশীলতা দেখা যায় এবং কবে থেকে?
অন্য ঐতিহাসিক বিষয়গুলির মতো এটিও প্রমাণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির অভাবে প্রথমদিকে একেবারেই অবহেলিত ছিল। এমনকী পরবর্তিকালে গবেষণা হলেও প্রাপ্ত নিদর্শনের কালমান নির্ণয়ে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা থাকায় কাচশিল্পে ভারতের অবদান বিষয়ে সবিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না বলেই মত দেওয়া হতো। কিন্তু আধুনিক গবেষণা ধারণার মোড় ফিরিয়েছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদরো তো অবশ্যই, সমগ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে ২০০টিরও অধিক খননস্থান থেকে বহু কাচ-বস্তু বা তার কাছাকাছি যেমন Faence, Glaze অর্থাৎ যেগুলি কাচের মতো পদ্ধতিতেই তৈরি করা হয়—এমন নিদর্শন মিলেছে। শেষোক্ত বস্তুগুলি গবেষক, অ্যাসোসিয়েশন ফর বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব হিস্ট্রি সাধারণত সিলিকা, লাইম, অ্যালকালিকে (সোডা বা অ্যান্ড ফিলজফি অব সায়েন্স আর্টস মিউজিক পটাশ) উচ্চ তাপমাত্রায় মিশ্রণ ঘটিয়ে, আবার কখনো porcelene)। এই প্রলেপদানও কাচ প্রস্তুতির প্রাথমিক স্তর বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই একে দেশীয় ভাষায় 'কাচ পরানো' বলা হয়। এরকম বস্তুর নিদর্শন শেষের তাতে অ্যালুমিনারও মিশ্রণ সহযোগে বিভিন্ন পাত্রের বেগুনি—MnO+CuO; অ্যামেথিস্ট — MnO+Fe O ওপর প্রলেপ দেওয়া হয় (চিনেমাটির পাত্রাদি/ ceramics, হলুদ Fe, O : কমলা (অস্বচ্ছ) CuO + SnO; ইত্যাদি। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা নির্দ্বিধায় একথা প্রমাণ করে যে, ভারতে একেবারে নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং অত্যন্ত উন্নত ধারাতেই কাচশিল্পের বিস্তার ঘটেছিল। বিশেষজ্ঞরাই পূর্বপ্রচলিত ধারণায় অ্যাসিরীয় প্রভাবকে বাতিল করেছেন এবং প্রাচীনত্বেও তা অন্য সভ্যতাগুলির অগ্রজ—একথাও বর্তমানে মান্য হয়েছে। এবিষয়ে Pliny, Strabo, Apollonius, Mackay সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় পদ্ধতি নিজস্ব। Pliny-র মত— "Glass of India is superior to all other countries." এবং কাচশিল্পও সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।”
দিকের হরপ্পার খননস্থান (১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে শুরু করে সম্প্রতি আবিষ্কৃত মেহেরগড়ের বেশ কিছু অঞ্চলেও (৪৪০০–৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পাওয়া গিয়েছে।
কিন্তু সরাসরি কাচের নিদর্শন কোথায়? হরপ্পা- মহেঞ্জোদরোর সর্বত্রই বহু কাচের পুঁতি, চুড়ি, শিল্পবস্তু, কাচপাত্র যেমন পাওয়া গিয়েছে; তেমনি নাসিক, মহেশ্বর (মধ্যপ্রদেশ), কোল্হাপুর, কোণ্ডাপুর, নেভাসা, অহিচ্ছত্র, গাঙ্গেয় উপত্যকাতেও বহু নিদর্শন মিলেছে। প্রাপ্ত নিদর্শন বিষয়ে আধুনিক গবেষণা যথেষ্ট গভীরে প্রবেশ করেছে, কিন্তু তা নিয়ে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। উৎসাহী পাঠকেরা তথ্যসূত্র অনুসরণ করতে পারেন। তবে একটি বিশেষ দিক তুলে ধরতেই হচ্ছে—ভারতীয়রা কিন্তু শুধু সাধারণ স্বচ্ছ (সাদা) কাচের ওপরেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল তা নয়। কাচকে বিভিন্ন রাসায়নিক সহযোগে বিবিধ রঙে তৈরি করে তা দিয়ে শিল্পবস্তু নির্মাণেও সিদ্ধহস্ত হয়েছিল। এরূপ নিদর্শন মেসোপটেমিয়াতে পাওয়া গেলেও ভারতীয় কাচশিল্পীরা দক্ষতার এমন উচ্চতায় উঠেছিল, যা বোধহয় আজও ঈর্ষণীয়। আলাদা আলাদা রঙের, মিশ্রিত রঙের (multicoloured), এমনকী কাচের ওপর সোনার প্রলেপ এবং তার ওপর আবার কাচের আস্তরণও দিতে তারা দক্ষ ছিল। কাচের তার বা সুতো তৈরি করে এমন বিভিন্ন রঙের সুতো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত সব শিল্পকর্মের নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে ব্রহ্মপুরীর কিছু খননস্থানে। নিচে তাদের ব্যবহৃত রঙিন কাচের কিছু রাসায়নিকের উল্লেখ করা হলো—লাল – Cu, O, Cu; খয়েরি (chocolate)- CuO + Fe2O3 ; কালো-FeO+MnO, FeO + Co0; সাদা—Sb, O, SnO; সবুজ – CuO, FeO; নীলচে এ তো হলো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাবলি, কিন্তু বেশির ভাগ প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে যেসমস্ত লেখ-প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে কিন্তু কাচের ব্যবহার যে রীতিমতো গহনা ও সৌখিন দ্রব্যাদিতে বিপ্লব এনেছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় যজুর্বেদ-এর ‘কপিষ্ঠল কঠসংহিতা'য় (৩।৯)। সেখানে সোনার সুতোয় কাচের অলংকরণে (পুঁতি বা অন্য গঠন) গহনার উল্লেখ আছে। শতপথ ব্রাহ্মণ (১৩।২।৬।৮) ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-এ (৩৯।৪।৪-৫) অশ্বমেধের ঘোড়া বা সাধারণ ঘোড়াকে সাজানোর জন্য কাচ বা পুঁতির (glass-beads) উল্লেখ আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ (৬৷৩০।১) একেবারে ভিন্ন একটি শব্দ ‘কংসো’র দ্বারা কাচকর্ম বা শিল্পের (glass work) কথা বলা হয়েছে।
রামায়ণ-এ (আদিপর্ব, ৯০।২৭) রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভরতের সঙ্গে অযোধ্যাবাসীদের যাত্রার যে-বর্ণনা, সেখানে ‘কাচকার’ অর্থাৎ কাচশিল্পীর (glass workers) কথা আছে। মহাভারত-এ পরিষ্কার বলা আছে—এক বিশেষ পৃথ্বীতত্ত্ব (earth material)-কে আগুনে দিয়ে (তাপ সহযোগে) কাচ প্রস্তুত করা হয়। (বনপর্ব, ১৮৫। ১৩)
চরক, বিশেষত সুশ্রুত সংহিতায় কাচের ওষধি ও যন্ত্রাদি-পাত্রাদি বিবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। চরকে গাঢ় নীল-CoO; বাদামি চিকিৎসাস্থানে (১৮/১২৫) মুক্তাদ্যচূর্ণ নির্মাণে কাচলবণের FeO+MnO; গাঢ় বেগুনি—MnO (উচ্চ মাত্রায়); নীলচে (glass salt) ব্যবহার উল্লিখিত হয়েছে। সুশ্রুতে কাচের বড়
সবুজ—CuO + Fe O
পাত্রে খাদ্য পরিবেশন এবং বিকল্প উন্নত শল্যচিকিৎসার যন্ত্র কাচ দ্বারা প্রস্তুতির নির্দেশ আছে।
বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে [বিনয়পিটকের ‘মহাবন্ধ' (৫।৮।৩), 'চুলবন্ধ' (৫।৯।১)] বৌদ্ধভিক্ষুদের কাচদ্রব্য ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেখা যায়। কিন্তু এর কিছু সময় পরের সময় পরের মৌর্যযুগেই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এর বহু জায়গায় কাচশিল্পের প্রভূত উন্নতির লক্ষণ লিখিত আছে। 21১১ – ১৭, ৫/২, ১৪।১ ইত্যাদি অংশে কাচদ্রব্যের গুণমান, মহামূল্যতা, কাচশিল্প (industry) ও সেই সংক্রান্ত খাজনার উল্লেখ আছে।
জৈন ‘আচারাঙ্গ সূত্র'-এ (২।১।৬।১) দামি কাচপাত্রের ইঙ্গিত মেলে। আবার বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় কাচবস্তু বাণিজ্য-উপযোগী বলে উল্লেখিত। এছাড়া শুক্রনীতিসার, স্বপ্নবাসবদত্তা, কথাসরিৎসাগর, যুক্তিকল্পতরু, বিবিধ রসায়নের গ্রন্থাবলি, রসরত্নসমুচ্চয় ইত্যাদি প্রায় সর্বত্র, এমনকী শিবপুরাণ (২।৩।২৭), গরুড়পুরাণ (৭৩/৯- ১০) প্রভৃতি পুরাণগুলিতেও কাচদ্রব্য ব্যবহারের বহু উল্লেখ বর্তমান। আবার অমরকোষ-এ (২।৯।৯৮- ৯৯; ২।১০।৩০, ৩।৩।28) 'সিংহন' (glass-vessel), ‘শিক্যকাচ' (cup), 'কাচস্থালি'র (থালা) উল্লেখ আছে।*
এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে এই দীর্ঘ শাস্ত্র-পরম্পরার সময়কাল বিষয়ে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে যাব। ২০০ বছরের সযতনে লালিত আর্য-অনুপ্রবেশ তত্ত্ব এবং বেদাদি সংহিতা থেকে ব্রাহ্মণ-উপনিষদাদির জন্য ২০০ বছরের পার্থক্য ইত্যাদি হিসাবে ভারতের ইতিহাস ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে পরবর্তী ২০০০ বছরের মধ্যেই সমাপ্ত হয়, এমনকী রামায়ণ-মহাভারত পর্যন্ত। এই বস্তাপচা ধারণাটিকে ছুঁড়ে ফেলে আধুনিক গবেষণায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ১৪৫০০ খ্রিস্টপূর্ব ঋগ্বৈদিক কাল থেকে রামায়ণ ৫৫০০ খ্রিস্টপূর্ব, মহাভারত ৩১৬২ খ্রিস্টপূর্ব, বুদ্ধদেব ১৯৪৪-১৮৬৪ খ্রিস্টপূর্ব, মৌর্যকাল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব ইত্যাদি দাঁড়ায়। সুতরাং সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে কিন্তু কাচশিল্প-বাণিজ্যের ভারতীয় ক্রিয়াশীলতাও অনন্যসাধারণ স্থান দখল করে আছে।
এবারে কাচের একটি বিশেষ প্রয়োগক্ষেত্রে ভারতীয় অবদানের সামান্য আলোচনা করে লেখার
ইতি টানা যাক। কাচ পদার্থটির একটি বিশেষ প্রয়োগ হলো দর্পণ বা লেন্স প্রস্তুতি এবং সেই সূত্রে চশমার উৎপত্তি। এবিষয়েও যথারীতি পাশ্চাত্য অবদানেরই গুণগান। বলা হয়, ১৪-১৫ শতাব্দী নাগাদ ইতালির পিসা শহরে প্রথম লেন্স তথা চশমারও (spectacles) আত্মপ্রকাশ। কিন্তু শঙ্করাচার্যের (আদি শঙ্কর বা দ্বিতীয় কৃপাশঙ্কর) বিখ্যাত গ্রন্থ অপরোক্ষানুভূতির ৮১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে—'বস্তুসকলের সুক্ষ্মতা যেমন 'উপনেত্র (চশমা) দ্বারা স্থূলত্বে প্রতিভাত হয়...' ইত্যাদি। সুতরাং এখানে কাচের চশমা অর্থাৎ লেন্সের (magnifying glass) উল্লেখ করা হয়েছে। শঙ্করের মান্য কাল অষ্টম শতাব্দী। সে-হিসাবে তো অবশ্যই, কিন্তু আধুনিক গবেষণা ধরলে আদি ও দ্বিতীয় শঙ্করের কাল দাঁড়ায় ৫৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।' তাহলে লেন্স-দর্পণের উদ্ভব কবে? এমনকী পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘ব্যাসরায়' নামে জনৈকের জীবনী বলছে যে, তিনি বই পড়ার জন্য চশমা ব্যবহার করছেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের 'দেবনারায়ণ' নামে এক স্থপতি-শিল্পীকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে, যিনি লেন্স ও চশমা বানানোয় দক্ষ ছিলেন। তারও আগে উক্ত সাম্রাজ্যের তাঞ্জোরে চশমা ও লেন্স তৈরি হতো একটি বিশেষ সম্প্রদায় দ্বারা। সুতরাং ঐ সময়ে ভারতবর্ষে তা একটি শিল্পের স্থান অধিকার করেছে। বরং বলা যায়, আরবদের হাত ধরে ভারতীয় বিজ্ঞানের অন্যান্য ধারার মতো এটিও পাশ্চাত্যে পৌঁছেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ। "
এই লেন্স বা দর্পণ এবং তার একেবারে আধুনিকতম কিছু প্রয়োগ বিষয়ে কিন্তু দুটি প্রাচীন শাস্ত্রও বিশেষ পদ্ধতিগত আলোচনা করেছে। শাস্ত্র-দুটি মহর্ষি ভরদ্বাজের নামে প্রচলিত ও বোধানন্দ যতি কর্তৃক ব্যাখ্যাত —
(১) যন্ত্রসর্বস্ব, যার কেবল বৈমানিক প্রকরণটুকু পাওয়া যায়। ও (২) অংশুবোধিনী। প্রথমটি যেমন চর্চিত, তেমন বিতর্কিতও। যাই হোক, সেই বৈমানিক শাস্ত্রে আতসকাচ বা লেন্স ব্যবহার করে মাঝ আকাশে জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সৌরবিদ্যুৎকে কাজে লাগানোর পদ্ধতির বর্ণনা আছে। সেই কাজে ১৯২ প্রকারের কাচ ব্যবহার করা হতো বলে উল্লেখ। এছাড়া ‘দর্পণাধিকরণম্' অধ্যায়ে 'শকট্যাকর্ষণ দর্পণ' (শক্তি আহরণকারী), 'বিশ্বক্রিয়া দর্পণ’, ‘কুন্তিনী’, ‘রৌদ্রী' ইত্যাদি দর্পণের ক্রিয়াকলাপ কাচবিজ্ঞানের ইতিহাস, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবটাকেই স্বচ্ছ বর্ণিত হয়েছে। যদিও এই গ্রন্থটির প্রাচীনতা নিয়ে বহু বিতর্ক। তবে দ্বিতীয়টি তুলনায় কম চর্চিত-বিতর্কিত।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই, অংশুবোধিনী শাস্ত্রেও আলোক ও বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয়ে আলোচনা আছে এবং সেই সূত্রে লেন্স নিয়ে। অতি সংক্ষেপে দুটিমাত্র উল্লেখ করে এই গ্রন্থের গুরুত্ব তুলে ধরা যাক। প্রতিবেদকের নিজেরই নাগপুরে স্থিত VNIT-তে তৎকালে (২০১২) মেটালার্জি বিভাগের প্রধান ডঃ ভি. কে. দিদোলকরের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। তিনি ও তাঁর দল তখন অংশুবোধিনী শাস্ত্রানুযায়ী 'Infrared transparent glass ceramic' তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সেটি বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণেরও প্রস্তুতি তাঁরা নিচ্ছিলেন বলে জানান।'
দ্বিতীয় ঘটনাটি বেনারসের নারায়ণ গোপাল ডোংরের তৈরি ‘ধ্বান্ত প্রমাপক যন্ত্র’ বা স্পেক্ট্রোমিটার বা মনোক্রোমোমিটার—যে-যন্ত্র ও পদার্থগুলি বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বিকিরণ-মাত্রায় প্রিজম প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো বলে শাস্ত্রে প্রকাশ। এর একটি পদার্থ— 'প্রকাশ স্তম্ভনভিদ লৌহ' (non hygroscopic ranging 5000 cm 1 to 1400 cml) তৈরিও করা গিয়েছে জামশেদপুরের National Metallurgical Laboratory- তো
সুতরাং আজও যখন শাস্ত্রবর্ণিত পদ্ধতিতে অতি উন্নত যন্ত্রাদি নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে, তখন তা বিশেষ গৌরবের দাবি রাখে। এসমস্ত আলোচনা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় কাচ, লেন্স, দর্পণ বিষয়ক উন্নত জ্ঞানের নির্দ্বন্দ্ব পরিচায়ক। আমাদের উচিত উক্ত বিষয়ে আরো গভীর অনুসন্ধান করা। আরো খনন, আরো গবেষণা মহিমময়রূপে প্রকাশ করবে।
0 Reviews