Read more
খেরোয়ালী জীবন ও সংস্কৃতি
খেরোয়াল আদিবাসীদের নাগরিক সভ্যতা, রাষ্ট্রশক্তির বিকাশ সিন্ধু উপত্যকার মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, রাজপুতানা, গুজরাট, মধ্যপূর্ব দক্ষিণ ও সিংহলে ঘটেছিল। আবার পূর্ব ভারতবর্ষের ঝাড়খণ্ড এলাকা, ছোটনাগপুর, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমিতে এই উত্থান ঘটেছিল। প্রাক্-আর্যযুগে হিহিড়ি পিপিডির কথা ওরাঁওদের গান ও শ্রুতিকাহিনী থেকে জানতে পারা যায়। হিহিড়ি মানে হরপ্পা, পিঁপিড়ি মানে পাঞ্জাব। এখানে আদিবাসীরা খেরোয়াল নামে পরিচিত ছিল। আর্যরা এসে তাদেরকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিল। এরকম করার নিশ্চয় কোনও উদ্দেশ্য ছিল। দেখা গেল আদিবাসীদের জঙ্গল হাসিল করা, জমি ও নগর সভ্যতাকে ওরা ধ্বংস ও দখল করে নিল। খেরোয়ালদের পরাজয়ের কারণ মনে হয় নেতার অভাব এবং জমি ভূমি নিয়ে পরস্পরের আত্মকলহ।
সাঁওতালরা সমতলে বসবাস করতে এসে খেরোয়াল নাম থেকে বিচ্যুতি হল। ওরাওঁরা খেরোয়াল নামে আর পরিচয় ধরে রাখতে পারলো না। এরা কখনও কোল, কোড়া, ওরাওঁ, মাহালি নামে ভূষিত হল। কুরুক্ষেত্রে ওরাওঁরা বসবাস করতে গিয়ে কুরুখ হল। ওরাওঁদের ভাষা কুরুখ ও সাদরি। সাদরি হচ্ছে অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে সংযোগ রক্ষা করার ভাষা। এরা ছোটনাগপুর, শাহাবাদ, শাসারাম, রহতাসগড় প্রভৃতি এলাকায় বসবাস করার জন্য কিসান নামে পরিচিত হল। পালামৌতে বড় বড় কিমান পল্লী আছে। ওরাওঁরা কোয়েল নদীর ধারে বসবাসের জন্য কোল নামে পরিচিত হল। এরা উত্তরবঙ্গের চা বাগান এলাকায় বসবাসের জন্য মোদাসিয়া হল। সুন্দরবনে বসবাস করতে এসে নাম হল বুনা, বুনো, বালুয়া, সদার, মোড়ল, মণ্ডল, সিংসদার, রায়, শিকারী, নাইয়া ইত্যাদি। সুন্দরবনের আদিবাসীদের ভাষা সাদরি। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা সাদরি ভাষায় কথা বলেন। উত্তরবঙ্গের সাদরি ভাষাকে বলা হচ্ছে মোদেসিয়া ভাষা। সুন্দরবনের আদিবাসী পাড়াকে বুনো পাড়া বলা হচ্ছে। আবার বুদ্ধিজীবিরা পুথি-পুস্তকে হরিজন, গিরিজন, গিরিবাসী, হতমান লিখেছেন। ওরাওঁ আদিবাসীরা ঝোড়া কোদাল নিয়ে মাটি কাটার কাজ করেন বলে তাদেরকে বলা হচ্ছে কোড়া। কোড়াদের থেকে কোড়া পদবী চাপিয়ে দেওয়া হল। মুদি পদবীর আদিবাসীরা সুন্দরবনে বাস করছেন। এদের সাব-কাস্ট হচ্ছে কোড়া। অনেকে মুদি পদবী দেখে বলছেন এরা আদিবাসী নয়। আবার কোনদিন শুনতে পাব ওরাওঁদের পদবী সর্দ্দার বা সরদার হওয়ায় বাবুরা বলবেন এরা আদিবাসী নয়। এটা বলা কি যুক্তিযুক্ত হবে।
বর্তমানে শুনছি সরকারকে সাঁওতালী অ্যাকাডেমী গঠন করতে আদিবাসী সাঁওতাল ও দলিত মানুষের বুদ্ধিজীবিরা দাবী করছেন। আবার অন্যদিকে সাদরি ভাষীরা সাদরি অ্যাকাডেমী করতে সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিচ্ছেন। আদিবাসীদের শিক্ষার দিক যদি দেখতে হয় তবে সাঁওতালী ও সাদরি ভাষার অ্যাকাডেমী হওয়া বাঞ্ছনীয় । এটা যদি না হয়ে শুধু সাঁওতালী অ্যাকাডেমী গঠন করার সাথে সাথে নতুন বিদ্রোহের বীজ কিন্তু রোপণ হয়ে যাবে। আজ আমরা লক্ষ্য করছি আকাশবাণী কলকাতার রেডিও সেন্টারে কেবলমাত্র সাঁওতালীদের জন্য অনুষ্ঠান করে। অন্যান্য আদিবাসীদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হয়েছে। এরকম দ্বিতীয় কোন কাজ করতে হলে সমগ্র আদিবাসী গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। সাঁওতালরাই কেবল আদিবাসী নয়, বাকী আরও সাঁইত্রিশটি গোষ্ঠী ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভমিজ ইত্যাদিরাও আদিবাসী। এটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে। খেরোয়ালরা যেখানেই বসবাস করুক না কেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সারণা ধর্মকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। ওরাওঁরা এক সময় রাজত্ব করেছেন। রহতাস নামে তাদের একটা গড় ছিল। তিরহুত ছিল তাদের। মহম্মদ-বিন- বখতিয়ার উক্ত স্থান আক্রমণ করে প্রাণহানী ও লুট-পাট চালিয়ে ছিলেন। চেরো আদিবাসীদের সাথে ওরাওঁদের দ্বন্দ্ব প্রায় লেগেই থাকত। নাগবংশের আদিবাসীরা ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। শিশুপাল, জরাসন্ধ অনার্য রাজাদের নাম মহাভারত থেকে জানা যায়। রামায়ণের কাব্য পাঠে জানতে পারি বালি, সুগ্রিব, জটায়ু, নল, নীল ইত্যাদি আদিবাসী দিকপালদের নাম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মরা নিজেদের সঠিক ইতিহাস পাঠে আজও বঞ্চিত। আদিবাসীদের সঠিক ইতিহাস লেখা উচিত। অনার্য রাজা রাবণের যুদ্ধের কাহিনী আজও আদিবাসীরা ভুলতে পারেনি। এমনকি পরস্পরের মধ্যে বিবাহের আদান-প্রদানও ছিল। দেখা যায় মহারাজ শান্তনু অনার্যদাস কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেছিলেন, ভীম রাক্ষসী হিড়িম্বাকে বিবাহ করেছিলেন। অর্জুনের সাথে উলপী ও চিত্রাঙ্গদার বিবাহ হয়েছিল। নিষাদরাজ নল বিদর্ভরাজার কন্যা দময়ন্তীকে স্বয়ম্ভর সভা থেকে জয় করে এনেছিলেন। মহাভারতের যুগে আর্য- অনার্যদের মধ্যে মেলামেশা ব্যাপক প্রবর্তিত হয়, সমাজ সংস্কৃতিতে মিলনের মহাসুর বাজতে শুরু করেছিল। এ সুর একেবারে কেটে যায় পাল ও সেন রাজাদের আমলে। এটা সপ্তম শতাব্দী হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে এই বিশাল ভূ-খণ্ডের লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হলেন সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ, মুদি, মাল, মাহালি, লোধা, শবর, খেড়িয়া, চিকবারাইক, অসুর, অহির, বাগাল, নাগশিয়া, কোড়া ইত্যাদি। ভারতবর্ষের কূট রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশ রাজনৈতিক
সীমান্তে বিভক্ত। কিন্তু ভূ-প্রকৃতির অবস্থান ভাষা, সংস্কৃতি ঐক্যকে ধরলে সকল আদিবাসীর ধর্ম ও সংস্কৃতি এক। আদিবাসীদের ধর্ম সারনা। ভাষার দিক দিয়ে ধরলে সাঁওতালরা সাঁওতালী ভাষার কথা বলে। পশ্চিমবঙ্গে সাঁইত্রিশটি গোষ্ঠীর ভাষা সাদরি। সাঁওতালরা কেবল আদিবাসী নয়। বাকী ওরাওঁ, মুণ্ডা, ভূমিজ ইত্যাদিরা আদিবাসী। সকল আদিবাসীই শহরীর, শারহুল, দাঁসাই, করম, নাওয়া-খাওয়া, বড়হা নুড়ি বুড়হিয়া (মানে পিতৃমাতৃ তর্পণ) বাহা, জিতুয়া, রজঃ উৎসব, দাণ্ডাকাটা (বাংলায় যাকে নারায়ণ পূজা বলে) পূজা করেন। নাচ ও গানের মধ্যে তাদের মিল আছে। পূর্বে তাদের সামাজিক ইতিহাস নাচ গানের মধ্যে ছিল। বর্তমানে অনেকে এটাকে লেখনিতে তুলে ধরছেন। ছো, পাতা, ভুয়াঙ্গা, ডমকা, কাঠি, নাটুয়া, ডাহের, দুঃগেড়, নাচের পদক্ষেপ ঢাক, ঢোল, ধামসা, মাদল, বাঁশি, তরুধুতু, সানাই, রামসিঙ্গার বাজনাতে আদিবাসী সমাজ উদ্বেলিত হয়।
এ প্রবন্ধে পাঠকবর্গকে আদিবাসী সংস্কৃতির শারহুল পূজার সাথে একটু পরিচয় করাতে চাই। আদিবাসীরা ফুল ভালবাসেন। এক সময় আদিবাসী রমণীরা মাথায় গলায় এককথায় অঙ্গে ফুলে সজ্জিত হতেন। মাথায় গুঁজতেন ময়ূর, মোরগের পাখা । এখনও সে ধারা সমানে চলেছে। এটাকে সুন্দর করে বলার জন্য কাহ্ন ও সহরপাদের চর্যাগীতির পদ উল্লেখ করছি।
উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিন সবরী গুঞ্জরী মালী।।
অনুবাদ মনে হচ্ছে—উঁচু উঁচু পর্বত, সেখানে বাস করে শবরী বালিকা, শবরীর পরণে ময়ূরের পাখা, গলায় ফুলের মালা ।
নানা তরুবর মৌডলিল রে গঅনত লাগেলী ডালী। একেলী সবরী এবন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী।।
অনুবাদ—নানা তরু মুকুলিত হল, গগন স্পর্শ করল ডাল; কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী একেলা শবর এ বনে ঘুরে বেড়ায়।
সাঁওতালরা শারহুল পরবকে বাহা পরব বলে। ওরাওঁ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীরা বলে শারহুল পরব। এ পরব বা পূজা চৈত্র মাসের পঞ্চমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে এটাকে বসন্ত পূজা বলেন। বসন্তকালে গাছে গাছে কচি পাতা ও মুকুল সমারোহ হয়। গাছে ফুলে ফোটে, ফল ধরে। এ সময় গাছ ফুল ও ফলের ডালি নিয়ে উপস্থিত হয়।
আদিবাসীরা কৃষিজীবি মানুষ। তাদের সকল পূজা-পার্বণ কৃষিকাজের সাথে মিলিয়ে আয়োজন, শারহুল বা বসন্ত পূজার পর তারা বাড়িতে বুড়হা বুড়হিয়া পূজা না করে নতুন ফল ভক্ষণ করে না। পাহান বা পূজারী শারহুল পূজার কলসে শালফুল ও পাতার ডাল বাড়ি বাড়ি বিতরণ না করলে বুড়হা বুড়াহিয়া পূজা কেউ করতে পারেন না। বুড়হা বুড়হিয়া পূজাকে অনেকে পিণ্ডদান বলেন। আদিবাসীরা ব্রাহ্মণ দিয়ে পূজা করান না। তাদের নিজ পাহান বা পূজারী থাকে। তিনিই পূজা করেন। গৃহ দেবতার পূজা বাড়ির কর্তা করেন। বুড়হা বুড়হিয়া পূজাকে অনেকে বাৎসরিক শ্রাদ্ধের কাজ বলেন।
চৈত্র মাসে ধাতৃমাতা উদ্ভিদে ফুল ও ফলের সমারোহ ঘটিয়ে দিগ-দিগন্ত মুখরিত করে তোলে। এ সময় গাছেরা তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চৈত্র মাসের প্রখর রৌদ্রে মাটি ফেটে চৌচির হয়, পুকুর খাল-বিলের জল শুকিয়ে যায়। গাছেরা এসময় জল চায়, চাতক পাখি প্রখর রৌদ্রে জলের জন্য গান গায়। আদিবাসীরা এরূপ পরিস্থিতিতে ভূমি ও গাছের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মেঘের কাছে বৃষ্টি আহ্বান করে শারহুল পূজা করেন। তারা মনে করেন একজন প্রজননবতী মহিলার গর্ভে সন্তান এলে তাকে যত্ন সহকারে পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হতে সাহায্য করা দরকার। তেমনি তারা গাছের প্রজননবতী মহিলার ন্যায় পাতা, ফুল, ফলকে পূর্ণ বিকশিত হওয়ার জন্য শারহুল পূজার মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করেন।
আদিবাসীরা শারহুল পূজা কেমন করে করেন তা জানা যাক্। পূজার পনের দিন পূর্বে পাড়ার মাহত বা প্রধান পূজারীকে নিয়ে মাহতর বাড়িতে সভা হয়। সভায় পূজার দিন ও বিভিন্ন জিনিষ সংগ্রহ ও জোগাড় করার জন্য কমিটি হয়। কমিটিই সকল করে। ওরাওঁ আদিবাসীদের কিংবদন্তী থেকে জানা যায় পূর্বে শারহুল পূজায় কালো শূকর বলি দেওয়ার রীতি ছিল। বর্তমানে সেখানে কালো মুরগী বলি দেওয়ার রীতি এসেছে। কবে থেকে কেমন করে এ রীতি এসেছে তা সমাজের কেউ বলতে পারেন না।
পূজার দিন প্রত্যুষে পাড়ার প্রতিবাড়ির একজন করে পুরুষ স্নান করে মাহতর বাড়িতে উপস্থিত হন। পাহান উপস্থিত হলে পূজার সব জিনিষপত্র যথা আতপ চাল, সিদ্ধ চাল, মোরগ, মুরগী, পাচাই রান্নার জিনিষপত্র মসলা, কলাপাতা, গ্লাস, বাটি বাঁকে বয়ে এবং পাহান পূজার শালপাতা, সারণী সুপ (কুলতে) সাজিয়ে, শান্তি জলের নতুন ভাঁড় নিয়ে সকলের আগে চলা শুরু করলে বাকীরা মিছিল করে সারণা থানে উপস্থিত হন। বর্তমানে শালগাছের বড়ই অভাব। তাই তারা যে কোন পাড়ার সীমানার বাইরের গাছতলায় শারহুল পূজা করতে বাধ্য হচ্ছেন। সারণী থানে আসার সময় মাদল, ঢোল,
বাঁশি বাজিয়ে আসেন ৷ সারণা সুপে পূজার সামগ্রী আতপ চাল, সরষের তেল, প্রদীপ, সিঁদুর, শাল, খলসে ফুল, পাতা, ছোট ডাল-পাতায় সাজান হয়। মহিলারা শারহুল পূজায় সারণা থানে অংশগ্রহণ করেন না।
শারহুল পূজার স্থানটি পাহান গোবর দিয়ে লেপে রোগ মুক্ত করে নেন। কেহ জল তোলেন, কেহ রান্নার উনান তৈরি করেন। পূজার কাজে পাহানকে সাহায্য করার জন্য একজন সাহায্যকারী পাহান থাকেন। পাহান পূজার স্থানে ভূমিতে তিন স্থানে তিনটি সিঁদুরের টিপ দেন। এর অর্থ হচ্ছে ভূমির প্রজনন সৃষ্টি করা এবং ভূমির উর্বরতা কামনা করা। সিঁদুরের স্থানে এক-মুঠো করে আতপ চাল রাখেন। আতপ চাল রাখার অর্থ হল অপদেবতার কুদৃষ্টি নাশ করা। পূজার স্থানে নতুন ভাঁড়ে শান্তির জল, খলসে, শাল ফুল ও ছোট ডালসহ পাতা রাখেন। প্রদীপ জ্বালেন এবং ঘুঁটের আগুনে ধুনা পোড়ান। এরপর পাহান সাদা মোরগটির পা, মাথা ধুয়ে সিঁদুর টিপ দেন। এবার মোরগটি হাতে ধরে ডান হাতে এক মুঠো আতপ চাল নিয়ে দাঁড়িয়ে হেঁট হয়ে মন্ত্র সহকারে মোরগ চরান। আতপ চাল মোরগের মাথায় অল্প অল্প করে ফেললে মোরগ আতপ চাল খুঁটে খেয়ে চরে। এরকম তিন বার করার পর পাহান শারহুল দেবতাকে মোরগ বলি দিয়ে রক্ত উৎসর্গ করেন। এরূপ করার অর্থ কাম, ক্রোধ, লোভকে উৎসর্গ করা। সাথে সাথে পচাই জল সুরা রূপে মন্ত্র পাঠে উৎসর্গ করেন। একইভাবে লাল, কালো মোরগ দেবতার নামে উৎসর্গ করে ভূমিতে রক্ত দান করেন। পূজা শেষ হলে সকলে মিলে পচাই পান, নাচ, গান করেন। এর সাথে রান্নার কাজ চলে। মোরগের ছাল ছাড়িয়ে কুটে নিয়ে আতপ চালসহ তিরহিভাত রান্না হয়। রান্না হতে এবং দেবতাকে অন্ন ভোগ উৎসর্গ করতে পাহানের বিকেল হয়ে যায়। ভোগ উৎসর্গ হয়ে গেলে সকলে বসে ভোগ ভক্ষণ করেন।
আদিবাসীরা শারহুল পূজায় বিশেষ করে ওরাওঁ গোষ্ঠীর যে সব গান করেন তার মধ্যে ফেলে আসা দিনের দুঃখের গান করেন। নীচে একটি গান উল্লেখ করলাম।
সিং খাঁটি অউর সিং দুয়ার
হিহিড়ি, পিঁপিড়ি বাস কারি
রাহতান গড় হেরায় গেলাক
লুট লেলায় দিকু মানে সব।
এর অর্থ হচ্ছে সিং ঘাটি, সিং দুয়ারে বাস করার পর সিন্ধু ও পাঞ্জাবে বসবাস করার পর রহতাস গড় রাজত্ব হারিয়ে গেছে। আর এই সব ভিন দেশের মানুষ কেড়ে নিয়েছে।
সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার পালা। পাহান তারা সারনা সুপে শাল ফুল, ডাল, পাতা, শান্তির জল এবং অন্যেরা খাওয়া দাওয়ার জিনিসপত্র বাঁকে বয়ে নিয়ে মাহতর বাড়ির জিনিষপত্র মাহতর বাড়ি রেখে যে যার বাড়ি যায়। পাহান সারণা সুপ (কুলো) শান্তির জল নিয়ে নিজের বাড়ি যায়। এভাবে প্রথম দিন শারহুল পূজা শেষ হয়।
দ্বিতীয় দিন সকালে পাহান চার-পাঁচ জন প্রতিবেশীকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি শারহুল ফুল, শান্তির জল বিতরণ করতে ঢোল, মাদল বাজিয়ে শারহুল ফুল খুশির গান গাইতে গাইতে প্রতি বাড়ি যায়। পাহান ও তার সাথীরা উপস্থিত হলে বাড়ির গৃহিনী, অথবা বৌমা, কাঁসার থালা, ঘটিতে জল ও সরষের তেল নিয়ে পাহানকে থালায় পা রাখিয়ে পায়ে তেল মাখিয়ে ঘটির জলে পা ধুয়ে দেয়। পাহান এসময় হাতে শাল ফুল, ডাল পাতা দিয়ে শান্তি জল ছিটিয়ে দেন। সাথীরা এরূপ আপ্যায়ণে বাদ যান না । গৃহিনী শাল ফুল পাতা ডাল সমেত কোঁচড়ে নিয়ে বাড়িতে বুড়হা বুড়হিয়া পূজার জন্য যত্নসহকারে চালের বাতায় রেখে দেন। পাহানের সাথীরা এক ফাঁকে উঠানে জল ঢেলে শারহুল নাচ গান করে নেন। এ সময় যে গান তারা গেয়ে আনন্দ করেন সেরকম একটি গান উল্লেখ করলাম—
ধুতি রাঁগো কারিয়া রাঁগো (২)
সাঁই গোঁসাই সাঁই রাজা সাঁই অহি-রে, অহি-রে অহি।
শারহুল পূজার সময় বাড়ির গিন্নি গান করেন। সেরকম গান নীচে উল্লেখ করলাম।—
তুলুই, লুসুই ফুল মিয়া
কাঁহা পালে বারিঙ্গিক ফুল (২)
রাইস পাসলে মিয়া
আজেক দিন যাবেন শাশুরাল
যাদুর দিনে যাদু খেললে মিয়া কালকে দিনে যাবে শাশুরাল আজ মাঠা দিনে মাঠা খেল মিয়া কালকে দিনে যাবে শাশুরাল।
সাদরি ভাষায় অর্থ হচ্ছে, শারহুল পাজায় নানা রংয়ের ফুল দিয়ে পূজা পালন করা হচ্ছে। তাই পূজার দিনে নতুন বিয়ে হাওয়া মেয়েকে মা স্নেহ ভরে বলছেন 'বেটি/মা আজ শারহুল পূজা, ফুল খুশির দিন। আজ ইচ্ছামত খেলা করে নেও। আগামীকাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।”
অগুরু পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু রামচন্দ্র মুর্মু
ভারতের তথা পৃথিবীর আদিম জাতিগোষ্ঠীগুলির অন্যতম সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠী। এই সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠী আজও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্ত্বা হাজার হাজার বছরের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচিয়ে রেখেছে। পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর আবির্ভাবে সাঁওতাল জাতিসত্ত্বায় নবজাগরণ তো হয়েছেই, পৃথিবীর আদিম জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যেও নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ জেলায় পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর জন্ম। এই জেলার মহকুমা শহর রায়রংপুরের অনতি দূরে ডাহারডি (ডাণ্ডবোস) গ্রামের এক সাধারণ গরীব পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ১৯০৫ সালের ৫ই মে দিনটি ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা, এই শুভ বৈশাখী পূর্ণিমার পূণ্য লগ্নে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ডাহারিড গ্রামের মোড়ল নন্দলাল মুর্মু ওরফে সিদ মুর্মু ও মায়ের নাম ছিল সম্মা মুর্মু। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয় চুনু মুর্মু। জানা গেছে এই নাম রাখার পর থেকে তিনি নাকি অনবরত কেঁদেছিলেন। সবাই খুব অস্থির হয়ে এক ওঝাকে দিয়ে গণনা করান। গণনা করে জানা গেল তাঁর 'চুনু' নাম দেওয়াটা ঠিক হয়নি, নতুন করে তাঁকে নাম দিতে হবে। তখন নতুন নামকরণ করে তাঁর নাম হল রঘুনাথ মুর্মু।
সাত-আট বছর বয়সে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। নিকটবর্তী গ্রাম গাঁঙারিয়া ইউ. পি. স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়। স্কুলে উড়িয়া ভাষাতেই পড়নো হোত, এই উড়িয়া ভাষা তিনি একদম বুঝতে পারতেন না। বলতেন—মাষ্টারমশাই কি যে বলেন কিছুই বুঝতে পারি না। আমাদের ভাষায় (সাঁওতালী) কেন পড়াচ্ছেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে জানতে পারলেন যে সাঁওতালী ভাষার কোন অক্ষর বা লেখা নেই বলে স্কুলে আমাদের ভাষায় পড়ানো হয় না। এই ভাষা সমস্যার জন্য তাঁকে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়। স্কুলের পড়া একদমই পারতেন না। তাই স্কুলে আর পড়বেন না বলেও বায়না করেছিলেন। তাঁর বাবা অনেক বুঝিয়ে বলেছিলেন যে রোজ স্কুলে গেলে সব পড়াই বুঝতে পারবেন। বুঝতে না পারলেও বাবার কথায় এখন থেকে রোজই স্কুলে যেতে লাগলেন। এই সময় সাওনা মুর্মু (সম্পর্কে মামা) ঐ স্কুলেই পড়তেন। তিনিও তাঁকে বলতেন—কিছু বুঝতে হবে না, বইয়ে যা লেখা আছে বার বার পড়ে মুখস্থ কর। কিছু না বুঝে পড়তে পড়তেই উড়িয়া ভাষা শিখতে লাগলেন। এইভাবেই দু-বছর কেটে গেল এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর পড়া শেষ করলেন।
মামা সাওনা মুর্মু ঐ বছরই ইউ. পি. পরীক্ষা পাশ করে গাঁঙারিয়া স্কুলের পড়া শেষ করলেন। বেশ কিছু দূরে বহড়দা এম. ই. স্কুলে ভর্তি হলে পর রঘুনাথকেও তাঁরই সঙ্গে ঐ স্কুলে বদলী করা হয় এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেক দূর ছিল। তাই স্কুলের কাছে বানাডুংরীতে একটি বাসা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হল। ভাষা সমস্যা রয়েই গেল, ফলে স্কুলের পড়া ভাল পারতেন না। এই সময় ইতিহাসে আর্য-অনার্য কথা পড়ে জানলেন যে সাঁওতালরা অনার্য। তাই অন্যরা তাদের ছোট জাত এবং অসভ্য ভাবে। ব্যাপারটা তাঁর মনটাকে খুবই নাড়া দিল, মনে পরিবর্তন দেখা দিল। স্কুলের পড়ার ফাঁকে এবং ছুটির সময় অন্য ছেলেদের সঙ্গে না খেলে একা বসে কি সব আঁকতেন এবং এটা সেটা তৈরী করতেন। এভাবেই তাঁকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তে দেওয়া হল। কিন্তু এল. পি. পরীক্ষায় আর পাশ করতে পারলেন না। শেষকালে তাঁর বাবা তাঁকে পড়াবার জন্য এক মাষ্টারমশাই ঠিক করলেন। মাষ্টারমশাই-এর কাছে পড়ার ফলে পরের বারে ভালভাবেই পরীক্ষায় পাশ করলেন। এই বহড়দা স্কুল হতেই এম. ই. পাশ করে বারিপদা হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন।
নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে থেকে পড়াশোনা করার সময় তিনি বাস্তবকে উপলব্ধি করলেন। সাঁওতাল জাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দূরবস্থা তার মনকে নাড়া দিল। এই দুর্দশাগ্রস্ত সমাজের জন্য তাই ভাবতে লাগলেন। “উড়িষ্যা, বিহার বাংলা ও আসামে সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কম নেই— একতার অভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে থাকার ফলে বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অশিক্ষার অন্ধকারে থাকার ফলে কুসংস্কারে জর্জরিত—তাই অন্যেরা তাদের ঘৃণার চোখে দেখে থাকে । কিভাবে কি করলে এই সাঁওতাল জাতির মধ্যে একতা আনা যায় এবং তাদের উন্নতি সাধন সম্ভব করা যায়; যাতে তারাও অন্যের মতো সমান মর্যদা পাবে, ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবে না।” এইসব বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে করতেই সমস্যা সমাধানের সূত্রটি খুঁজে পেলেন। মাতৃভাষা সাঁওতালীতে শিক্ষার ব্যবস্থা সম্ভব করতে পারলেই সাঁওতাল জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। এই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য চাই সঁওতালী ভাষার নিজস্ব লিপি, যেটা তাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে গোটা সাঁওতাল সমাজকে এক সূত্রে বেঁধে একতা ফিরিয়ে আনবে।
সাঁওতালী ভাষার জন্য এক ও অভিন্ন লিপি চাই। এই চিন্তাভাবনা তাঁর মনে আগে থেকেই ছিল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। এতএব ১৯২৪ সালে বারিপাদা হাই স্কুলে পড়ার সময় সাঁওতালী ভাষার উপযোগী লিপি উদ্ভাবনের কাজ পড়াশোনার সাথে সাথেই চলতে লাগল। এই সময় সাওনা মুর্মু মহাশয়ও শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য
বারিপাদায় ছিলেন। তাঁর প্রেরণা ও নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে সাঁওতালী ভাষার উপযোগী লিপি উদ্ভাবনে সক্ষম হন কিন্তু পড়াশোনার চাপে সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। ঐ বছরই রঘুনাথ মুর্মু মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করলেন, কিন্তু বাড়ীর সমস্যার জন্য লেখাপড়া আর চালিয়ে যেতে পারলেন না। বাড়ীতে ফিরলেন এবং কাপড় বোনার কাজ শিখতে লাগলেন। এই সময়ে আমজুড়িয়া কুচুং গ্রামের মেয়ে নহা বাস্কের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। অবশেষে ১৯২৫ সালে তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সমর্থ হন এবং সাঁওতালী ভাষার জন্য নিজস্ব লিপি ‘অলচিকি’ তৈরীর কাজ প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ করেন।
কয়েক বছর বাড়ীতেই থাকলেন। সংসারে কাজকর্মের সাথে সাথে কাপড় বোনার কাজ করতে লাগলেন। তিনি যে লিপি উদ্ভাবন করেছিলেন কাজের চাপে তার জন্য আর বেশী কিছু করতে পারলেন না। কেবল মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হল আর বিশেষ বিশেষ লোকের মতামত সংগ্রহের জন্য সাওনা মুর্মু মহাশয় প্রচার করতে থাকলেন। সবাই খুব ভাল কাজ হয়েছে এবং প্রয়োজন আছে বললেও তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। এই অবস্থায় কি করতে হবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এমন সময় ১৯২৮ সালে ধলভূমির চেমেজুড়ী গ্রামে একটি সামাজিক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ঠিক করলেন, অলচিকি লিপিকে তুলে ধরার জন্য সেই সভায় যোগদান করতে হবে। যথাসময়ে সভায় যোগদান করলেন এবং লিপির বিষয়ে বক্তব্য রাখলেন ৷ সাঁওতালী লিপি আবিষ্কারের কথা জানতে পেরে উপস্থিত সকলেই অবাক হলেন এবং লিপির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করলেন।
আগের মতোই চলতে লাগল। হাতে-কলমে নানা ধরনের কাজ করতে করতে কারিগর হিসাবে খুবই পটু হয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে ১৯৩১ সালের লোক গণনায় অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কিছুদিন কাজও করলেন। তার ঠিক পরেই বারিপাদা পাওয়ার হাউসে কারিগরি শিল্পে শিক্ষনবিশী হিসাবে যোগদান করলেন এবং ১৯৩২ সালে সসম্মানে পাশ করে বাড়ীতে ফিরে এলেন। পুনরায় কাপড় বোনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। বাড়ীতেই সুন্দর সুন্দর নক্সাযুক্ত রঙ-বেরঙের কাপড় তৈরী করতে লাগলেন । তাঁর রঙিন কাপড় খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তাঁর নক্সাযুক্ত কাপড় দেখে তখনকার দেওয়ান মহাশয় তাঁর খুব প্রশংসা করেন এবং সেকথা মহারাজা প্রতাপচন্দ্র ভঞ্জদেও-এর কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর এই প্রতিভা দেখে দেওয়ান সাহেব তাঁকে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং নিতে অনুরোধ করেন। দেওয়ান সাহেবের সুপারিশ এবং মহারাজার অনুগ্রহে রঘুনাথ মুর্মুকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য কলকাতা, শ্রীরামপুর ও গোসাবায় পাঠানো হয়েছিল। সমবায়ের কাজ হাতে-কলমে শেখার জন্য তাঁকে বোলপুরেও পাঠানো হয়েছিল। এর ফলে কারিগরিতে তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আগের তুলনায় আরও বেড়ে গেল। তাঁর এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার জন্য তাঁকে বারিপাদা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-এ ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ করা হল। কিন্তু বেশীদিন এই পদে কাজ করতে পারলেন না। তাঁদের সংসারে নানান সমস্যা দেখা দিল। এই সময়ই তাঁর বাবার মৃত্যু হলে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর উপরই চেপে বসল। বারিপাদায় থেকে চাকরি করা আর সম্ভব হল না। তিনি দেওয়ান সাহেবের কাছে নিজের অসুবিধার কথা জানিয়ে অনুরোধ করলেন যে কম বেতনে হলেও তাঁকে যেন রায়রংপুরের কাছাকাছি কোন স্কুলে শিক্ষকতার কাজ দেওয়া হয়, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন। দেওয়ান সাহেব তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি তাঁর অসুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। তাঁদের বাড়ীর কাছেই ১৯৩৩ সালে বডামতাড়িয়া ইউ. পি. স্কুলে তাঁকে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল টিচার পদে নিয়োগ করা হয়। এই সুবাদে কিছুদিন পরেই স্কুলটিকেও মডেল ইউ. পি. স্কুলের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং রঘুনাথ মুর্মুকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত রঘুনাথ মুর্মু বডামতাড়িয়া মডেল ইউ. পি. স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। তার আগে থেকেই সাওনা মুর্মু মহাশয়ও ঐ স্কুলেই শিক্ষক পদে নিযুক্ত ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের পুনর্মিলন রঘুনাথ মুর্মুর জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দুজনে মিলে অলচিকি লিপির প্রচার করতে লাগলেন। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে লিখতে পড়তে জানা মানুষদেরকে লিপি সম্বন্ধে অবহিত করতে লাগলেন। যাঁরা শিক্ষক ছিলেন তাঁদেরকে পরখ করার জন্য আহ্বান জানালেন। এইভাবে প্রচারে ভালই সাড়া পাওয়া গেল। বেশ কিছু শিক্ষিত মানুষকে তাঁর নতুন লিপি সম্পর্কে বোঝালেন এবং শেখাতে থাকলেন। ইতিমধ্যে রঘুনাথ মুর্মু সাহিত্য চর্চাও শুরু করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন সঙ্গীত প্রিয় সাঁওতালদের মধ্যে গানের প্রভাব খুব বেশী, তাই তিনি গান লিখতে শুরু করলেন এবং ১৯৩৬ সালে 'হর সেরেঞ' (পথ সঙ্গীত) নামে একটি গানের বই বাংলা হরফে ছেপে প্রকাশ করলেন। সাধারণ মানুষের কাছে লিপির কথা পৌঁছে দেবার জন্য একটি নাটকও লিখলেন। নাটকটির নাম ‘বিদু চাঁদান'। ১৯৪২ সালে উড়িয়া লিপিতে প্রথম প্রকাশিত হলেও নাটকটি ১৯৩৬ সালেই লেখা হয় এবং ঐ সময়ে টাটা, জামতাড়া, বাগবুদা প্রভৃতি স্থানে মঞ্চ স্থ হয়েছিল। ‘বিদু চাঁদান' নাটকে সাঁওতালী ভাষায় ভাব আদান-প্রদানের চিহ্ন স্বরূপ ঐ লিপিগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছিল। 'বিদু চাঁদান' নাটক সেই সময়ে বিহার, বাংলা, উড়িষ্যায় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই নাটকের গান সেই সময় সকলের মুখে মুখে শোনা গিয়েছিল।
নতুন লিপি সম্পর্কে সকলেই মতামত ব্যক্ত করলেন। অধিকাংশ মানুষ প্রশংসা করলেও অনেকে তার সম্ভবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। রঘুনাথ মুর্মু বুঝলেন শুধু মুখে প্রচার করে বেশী দূর এগানো সম্ভব নয়। লিপিকে ছেপে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু ছাপতে গেলে অনেক টাকা চাই, তাছাড়া ছাপাবেনই বা কোথায়? ঠিক করলেন নিজেই টাইপ তৈরী করবেন। কারিগরী শিল্পে দক্ষতা থাকায় তাঁর কোন অসুবিধা হয় নি। অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবশেষে ১৯৩৮ সালে অলচিকি লিপির পিতলের টাইপ এবং কাঠের একটি ছাপা কল তৈরী করলেন। ছাপা কলে কাগজ ছাপা হল এবং সেগুলি সাওনা মুর্মু মহাশয় প্রচার করতে লাগলেন। এই বিরাট কর্ম যজ্ঞে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর সাফল্য সাওনা মুর্মুর প্রেরণা ও সক্রিয় সহযোগিতার জন্যই সম্ভব হয়েছিল।
এমন সময় হঠাৎ একদিন স্কুলের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট তাঁদের স্কুল পরিদর্শনে এলেন। সবকিছু দেখে খুশি হলেন, বিশেষ করে স্কুলের কর্মশালা দেখে। জিজ্ঞাসা করলেন বারিপাদা শিল্প প্রদর্শনীতে তাঁরা কি কি পাঠাবেন। তখন তাঁরা ঐ ছাপাকলের কথা বললেন এবং সেটা তাঁকে দেখালেন – কিভাবে ঐ ছাপাকলের সাহায্যে কাগজে ছাপা হয়। ছাপাকলটি দেখে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট খুব প্রশংসা করলেন। যাবার সময় পরিদর্শকের মন্তব্যে বারিপাদা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করার কথা লিপিবদ্ধ করে গেলেন। ফলে সরকারী নির্দেশে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া গেল । প্রদর্শনীর জন্য অনেকগুলি কাগজে অলচিকি লিপি ছাপলেন এবং তার সাথে বাণীও ছাপা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে সাওনা মুর্মু মহাশয়কে কাগজ, অলচিকি টাইপ এবং কাঠামো তৈরী ছাপাকল সমেত বারিপাদার প্রদর্শনীতে পাঠানো হয় । বহুলোক ছাপাকলটি ও তাঁর কাজ চাক্ষুস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এইভাবে সরকারী প্রদর্শনীর মাধ্যমেও বহু মানুষ সাঁওতালী ভাষার লিপি ‘অলচিকি' আবিষ্কারের কথা জানতে পারলেন। শেষ দিনে পদাধিকারীদের সঙ্গে মহারাজাও প্রদর্শনী দেখতে এলেন এবং রঘুনাথ মুর্মুর আবিষ্কার দেখে মুগ্ধ হলেন। এইভাবে রাজা থেকে প্রজা সবাই তাঁর ছাপাকল আবিষ্কারের কথা জানতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতালী ভাষার লিপি অলচিকির কথাও জানতে পারলেন।
ধীরে ধীরে লিপি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ বাড়তে লাগল। সাঁওতালী ভাষারও নিজস্ব লিপি হোক অধিকাংশ মানুষই এটা চাইলেন। নতুন লিপি তাঁদের ভাবাবেগকে নাড়িয়ে তুলল। অলচিকি লিপির অনুরাগীর সংখ্যা বাড়তে লাগল । এমন সময় ১৯৩৯ সালে বড়ামতাড়িয়াতে একটা সম্মেলন ডাকা হল। সেই সম্মেলনে প্রচুর জন সমাগম হল। এই সম্মেলন থেকে একটি কমিটি গঠন করা হল যার নাম—'অল সমিতি' । পরে এই সমিতির পক্ষ থেকে মহারাজের কাছে দাবী সনদ পেশ করা হয়েছিল। তাতে দাবী করা হয়েছিল সাঁওতালী ভাষায় তার নিজস্ব লিপিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। মহারাজা বললেন যে সাঁওতালীর জন্য লিপির প্রয়োজনীয়তা তিনি মনে করছেন না, তবুও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পরে 'অল সমিতিকে' লিখিতভাবে জানানো হল যে সাঁওতালীর জন্য এই নতুন লিপি অনেক ব্যয় সাপেক্ষ এবং চালু করাটাও বিরাট সমস্যার। এই কথা জানার পর রঘুনাথ মুর্মু সমিতিকে জনসভা ডাকার প্রস্তাব করলেন। ‘অল সমিতি’ ডাহারডি গ্রামে গ্রীষ্মের ছুটিতে জনসভার আয়োজন করেছিল। ময়ূরভঞ্জ তো বটেই সিংভূম জেলা থেকেও দলে দলে লোকজন এসেছিল। ১৫ হাজারেরও বেশী লোক জমায়েত হয়েছিল। এই সভা থেকেও সাঁওতালী ভাষার নতুন লিপি গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত জানানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
এই ক’-বছরে তাঁর বিদু-চাঁদান' নাটক বিভিন্ন জায়গায় অভিনীত হয়ে খুবই জনপ্রিয় হল। আরও বহু জায়গার মানুষ নাটকটি পেতে চাইলেন। চাহিদার কথা ভেবে রঘুনাথ মুর্মু মহাশয় নাটকটি ছাপাবার কথা ভাবলেন। কিন্তু তাঁর সেই সামর্থ্য কোথায়? তাই তিনি বিশেষ বিশেষ লোকজনদের ডেকে বৈঠক করলেন। তাঁদের মধ্যে ঘাসিরাম হাঁসদা, মণিরাম বাস্কে, সাধুসামু মুর্মু, সুন্দর মোহন হেম্ভ্রম, সুনারাম সরেন মহাশয়দের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও টাটানগর থেকে বিশেষ বিশেষ লোকজনদের তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি নাটকটির চাহিদা ও ছাপাবার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁদের বললেন এবং সবার কাছে ছাপাবার জন্য আর্থিক সাহায্য চাইলেন। উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গে একমত হলেন এবং সবরকম সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। এইভাবে ১৯৪২ সালে ‘বিদু-চাঁদান’ নাটকটি উড়িয়া হরফে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে বাংলা ও অলচিকিতেও প্রকাশিত হয়েছে।
‘বিদু-চাঁদান’ নাটকের অনুষ্ঠানে ঐ সময় খুব লোকজন জড়ো হচ্ছিল। তার উপর নাটকটির জন্য সভাসমিতি করা এবং বই ছাপানের জন্য রঘুনাথ মুর্মু প্রশাসনের নজরে পড়লেন। কারণটা ছিল জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলন। সেই সময় জাতীয় কংগ্রেস বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। প্রশাসন মনে করেছিল এরাও কংগ্রেসের আন্দোলনে সামিল হয়েছে। অবশ্য তাঁদের সেই ভুল ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা প্রশাসনকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে তাঁদের কার্যকলাপের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। তারা কেবল সাঁওতালী ভাষার নতুন লিপির কথাই বলছেন সেটা প্রশাসন বুঝেছিল এবং এতে যে ময়ূরভঞ্জের সুনামই বাড়ছে সেটাও উপলব্ধি করেছিল। শিক্ষকতা করার সময়ই রঘুনাথ মুর্মু ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই সুযোগকে তিনি পূর্ণ কর্তব্যনিষ্ঠ সহকারে
কাজে লাগিয়ে সাঁওতালী সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেন। তাঁর অধিকাংশ লেখা এই সময়ই লিখেছিলেন। শেষের দিকে তাঁর পদন্নোতি ঘটিয়ে রায়রংপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে বদলী করা হয়েছিল। এই সময় ভাষা ও সাহিত্য চর্চার সাথে সাথে সমাজসেবামূলক কাজে এতবেশী জড়িয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর পক্ষে চাকরী করা সম্ভবপর ছিল না। তাই কিছুদিন পরই তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
সেই সময় টাটানগরের চাকুরীজীবি সাঁওতাল আদিবাসীরা ‘খেরওয়াল জারপা সমিতি' গঠন করেছিলেন। তাতে ময়ূরভঞ্জের অনেক সদস্য ছিলেন একথা রঘুনাথ মুর্মু জানতেন। তাই যখন তিনি অলচিকি লিপির ছাপাখানা তৈরীর কথা ভাবলেন তখন প্রথমেই তাঁদেরকে মনে পড়ল—যাঁরা টাকা দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে পারেন। তিনি টাটানগরে যাওয়া-আসা করতে লাগলেন। এমনই সময় মণিরাম বাস্কে মহাশয়, যিনি কারিগরী বিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন—তিনি বিদেশ থেকে ফিরলেন। ফিরেই রঘুনাথ মুর্মুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ছাপাখানা তৈরী করার তোড়জোড় শুরু করেন। এদিকে রঘুনাথ মুর্মু কলকাতার স্বদেশী টাইপ ফাউন্ড্রী থেকে অলচিকি লিপির টাইপ তৈরী করালেন। টাটানগরে ‘চাঁদান প্রেস' নামে ছাপাখানা তৈরী হল এবং সেই ছাপাখানায় ‘ঞেলজঙ লীগিৎ অল' নামে রঘুনাথ মুর্মুর একটি বই প্রথম অলচিকি লিপিতে ছাপানো হয়। এইভাবে অলচিকি লিপিতে সাঁওতালী ভাষায় বই ছাপার কাজ শুরু হয়। সুন্দর মোহন হেম্ভ্রম মহাশয়ের সম্পাদনায় ‘সাগেন সাকাম’ নামে এক মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করলো। কিন্তু শুরুতেই চাঁদান প্রেস বিরাট ধাক্কা খেল। হঠাৎই মণিরাম বাস্কে মহাশয় মারা গেলেন। তিনিই চাঁদান প্রেসের একমাত্র কর্ণধার ছিলেন। তাই তিনি মারা যাওয়ায় ছাপাখানার কাজ বন্ধ হয়ে গেল। রঘুনাথ মুর্মু চিন্তায় পড়ে গেলেন। সামান্য আশার আলো যাও-বা দেখতে পেয়েছিলেন সেটাও মিলিয়ে গেল।
বৃটিশ আমাদের দেশ ছেড়ে চলে গেলে স্বাধীন ভারতকে ভাষাভিত্তিক রাজ্যে বিভক্ত করা হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত ছোটনাগপুর মালভূমির পাহাড়, জঙ্গলে ভর্তি বিস্তীর্ণ এলাকাকে চারিটি রাজ্যে ভাগ করা হয়। এই সময় ময়ূরভঞ্জের আদিবাসীরা ময়ূরভঞ্জকে পৃথক রাজ্য করার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। যে সমস্ত আদিবাসী যুবক পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাঁরাই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সুনারাম সরেনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলন আদিবাসীদের মধ্যে যথেষ্ট উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল। বহু আদিবাসী নেতা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেছিলেন। পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুই যে আদিবাসীদের তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন সেকথা সরকার বুঝেছিলেন এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য পরোয়ানা জারি করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায় নি, খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন।
আত্মগোপন কালে সহচর এবং দূত হিসাবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আর এক বিশিষ্ট সমাজসেবী যাঁকে আমরা সবাই তৎকালীন দিশম গোড়েৎ বলেই জানি। তাঁর নাম শ্রদ্ধেয় সাধুসামু মুর্মু। আদিবাসী, বিশেষত সাঁওতালদের মধ্যে ধারণা জন্মেছিল যে ময়ূরভঞ্জকে আলাদা রাখতে পারলে তাঁদের ভাষা ও নতুন লিপি মর্যাদা পাবে; মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। কিন্তু তাঁদের এই আশা পূর্ণ হল না। সরকার তাঁদের নৈতিক অধিকারে আমলই দিলেন না। আদিবাসীদের এই আন্দোলনকে সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। স্বাধীন দেশের সরকার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ১৯৪৯ সালে গুঁডুরিয়ায় নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। সেই গুঁডুরিয়ায় ফায়ারিং-এর কথা আমাদের জানতে হবে যা আমরা অনেকেই জানি না।
বিন্দু চাঁদান প্রেস-এর কাজ বন্ধ হওয়ার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে রঘুনাথ মুর্মু খুবই হতাশা হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন না। কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করার জন্য ভাবতে লাগলেন। অবশেষে সিদ্ধান্তে এলেন যে—একটা বড়ো ধরনের সংগঠনই তৈরী করতে হবে, যেটা অলচিকি প্রসারের সাথে সাথে সামাজিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে কাজে লাগবে। ১৯৫২ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি অল সমিতির সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে বসলেন। একটি সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হল। নির্দিষ্ট দিনে 'বাদলা'র সম্মেলনে অল সমিতির বদলে নতুন সংস্থা ‘আদিবাসী সাঁওতা সেচেৎ লাকচার সেমলেৎ' গঠিত হল। বাংলায় এটাকেই 'আদিবাসী সমাজ শিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক সংস্থা' এবং ইংরাজীতে আদিবাসী সোসিও এডুকেশন্যাল এ্যাণ্ড কালচারাল এসোসিয়েশন' লেখা হয়ে থাকে। রায়রংপুরে সংস্থার কার্যালয় তৈরী হল। এই সংস্থায় শিক্ষিত এবং চেতনাসম্পন্ন অনেক সাঁওতাল আদিবাসীরা সদস্য পদ গ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁরা এই সংস্থার মাধ্যমে অলচিকি প্রসার এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করতে শুরু করলেন। সংস্থার কাজের জন্য এখানেও ছাপাখানার প্রয়োজন দেখা দিল। রঘুনাথ মুর্মু তাঁর এক ঘনিষ্ট আত্মীয়কে আর্থিক সাহায্যের অনুরোধ করলেন, তিনি ছাপাখানার খরচ বহন করলে তাঁরই নামে ছাপাখানা স্থাপিত হল। রঘুনাথ মুর্মুর 'অলচেমেৎ' বইটি ছাপিয়ে ছাপাখানাটি তার যাত্রা শুরু করে ছিল এবং এখনও আমাদের জন্য বহু মূল্যবান বই উপহার দিযে চলেছে।
উড়িষ্যায় আদিবাসী সমাজ শিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক সংস্থায় কাজ শুরু করার পর পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু বিহার এবং বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তে অলচিকি প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে থাকেন। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত, গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে গিয়ে তাঁর নিজের লেখা গান গ্রামবাসীদের গেয়ে শোনাতেন, গানের মর্মার্থ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতেন এবং তাঁর সেই বাণী দেওয়ালে দেওয়ালে লিখতেন। অবশ্যই আঞ্চ লিক ভাষার পাশাপাশি অলচিকি লিপিতে লিখতেন এবং অলচিকি বর্ণমালাও লিখতেন। এইভাবে তিনি বিহার-বাংলার বহু যুবককে চলার পথে তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন যে সাঁওতালী ভাষার জন্য এক এবং অভিন্ন লিপি বহন করলে সমগ্র সাঁওতাল সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে। তাই তাঁরা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ কল্যাণমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এইভাবে তিনি লিপি প্রচার ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্থাটিকে আরও মজবুত করতে সমর্থ হন। আদিবাসী সমাজ শিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ১৯৬৪ সালে উড়িষ্যায় প্রথম সরকারীভাবে নথিভুক্ত হয়। একইভাবে তাঁরই আদর্শে দীক্ষিত অনুগামীগণ বিহারে ১৯৬৫ ও পশ্চিমবাংলায় ১৯৬৭ সালে ঐ একই নামের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার পতাকাতলে ভারতবর্ষের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ আজ দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর মতাদর্শে তাঁরা একাত্ম হয়েছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও জাতিসত্ত্বা রক্ষা করতে হলে সমগ্র সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একই ভাষা সংস্কৃতির মানুষকে একই লিপির মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করতে হবে তবেই সাঁওতালী সাহিত্য সমগ্রতা লাভ করবে, সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব হবে—অন্যথায় নয়। এছাড়া, তিনি অলচিকিকে সাঁওতাল জাতিসত্ত্বার পরিচায়ক হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছেন এবং সাঁওতাল সমাজও এই অর্থেই অলচিকি লিপিকে গ্রহণ করেছেন। পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর মতবাদ ও আদর্শ সাঁওতাল জনমানসে নিঃসন্দেহে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছে। তিনি একাধারে যেমন একজন বিদগ্ধ দার্শনিক ছিলেন তেমনই একজন সুসংগঠক হিসাবেও তাঁর পরিচয় রেখে গেছেন।
সাঁওতালী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি পণ্ডিত মুর্মুর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছিল বলেই তিনি আজীবন তার প্রতি সজাগ ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন সাহিত্যের বিকাশ না ঘটলে কোন জাতিরই সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয় এবং প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই প্রকৃত শিক্ষালাভের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রচলনের উপরই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। বাল্যকালে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার অভাব অনুভব করেছিলেন বলেই সাঁওতালী ভাষার জন্য পৃথক লিপি অলচিকি আবিষ্কার করেন—যাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান সম্ভব হয়। সাঁওতাল আদিবাসীগণ বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করেন বলে আঞ্চলিক ভাষায় লেখাপড়া করতে বাধ্য হন। সেই কারণে শিক্ষিত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ এতদিন বাংলা, দেবনাগরী, উড়িয়া ও রোমান হরফে সাঁওতালী সাহিত্য লিপি সমস্যার কবলে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণতা বা সমগ্রতা লাভ করেনি। সাঁওতালী ভাষাভাষী হয়েও এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে সৃষ্ট ভিন্ন লিপির সাহিত্য সম্ভার সম্পর্কে আকৃষ্ট হননি বলে জানতেও পারেননি। এইরকম বিচ্ছিন্নভাবে সাঁওতালী সাহিত্যের সম্পূর্ণ বিকাশের কথা চিন্তা করে তিনি সমগ্র সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে একই লিপি 'অলচিকি' মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তিনি লিপি প্রচারের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।
সাঁওতালীতে সৎ-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু মহৎ প্রতিভার অধিকারী এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি মানুষকে আনন্দ দান ও সমাজের কল্যাণ করতে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আজীবন পূর্ণ কর্তব্যনিষ্ঠ সহকারে সাঁওতালী ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে কাজ করে গেছেন। সাঁওতালী সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর বিচরণ থাকলেও গান, কবিতা ও নাটক (যাত্রাপালা)-র ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি যখন শিক্ষকতা শুরু করলেন তখন থেকেই সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রথম গানের বই 'হর সেরেঞ' বা 'পথ সঙ্গীত' ১৯৩৬ সালে বাংলা হরফে প্রকাশিত হয়। তিনি এই সময়েই তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘বিদু-চাঁদান' লেখেন এবং বেশ কিছু জায়গায় নাটকটি অভিনীত হলে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। শেষে জনসাধারণের চাহিদা মেটাতে ১৯৪২ সালে ‘বিদু-চাঁদান' নাটকটি প্রথমে উড়িয়া হরফে প্রকাশিত হয়, পরে ১৯৪৭ সালে বাংলা হরফে এবং ১৯৮৭ সালে অলচিকি লিপিতে পুনরায় প্রকাশিত হয়। তাঁর 'ঞেলজং লাগিৎ অল' বইটি অলচিকি লিপিতে প্রথম প্রকাশিত বই। টাটানগরের চাঁদান প্রেস থেকে বইটি ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। অলচিকি লিপির প্রাথমিক পাঠ্য বই ‘অল-চেমেৎ' ১৯৪৭ সালে রায়রংপুরে থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তাঁর পরের নাটক ‘দাড়ে গে ধন' ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও নাটকটি ১৯৪৪ সালে লেখা হয় এবং অভিনীতও হয়। তাঁর 'খেরওয়াড় বীর' নাটকটি ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। সেই সময় নাটকগুলি উড়িষ্যা, বিহার ও বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লেখা গান সাঁওতাল আদিবাসীদের মুখে মুখে শোনা যেত। 'অল চেমৎ' ছাড়াও বেশ কিছু পাঠ্য বই তিনি লিখে গেছেন যেমন ‘এ্যালখা পতব (অঙ্কের বই) ‘পারসি পহা’, ‘পারসি ইতুন’, ‘রনড়’, ‘লাকচার সেরেঞ' ইত্যাদি। ‘রনড়’তাঁর লিখিত সাঁওতালী ব্যাকরণ এবং 'লাকচার সেরেঞ' একটি শিক্ষামূলক গানের বই। এই সংকলনের গানগুলি
তাঁর এক একটি বাণী, যে বাণীগুলি সাঁওতাল সমাজকে চিরকাল ধরে পথ দেখাবে। লিপি প্রচারের সময় এই গানগুলি তিনি গ্রামে গ্রামে গেয়ে শোনাতেন এবং শ্লোগান হিসাবে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখতেন, এখনও এগুলি শ্লোগান হিসাবে লেখা হয়ে থাকে। এছাড়াও তিনি ‘অল উপুরুম’, ‘পারসি দারে’, ‘পারসি গাজাড়' ইত্যাদি বই লিখে গেছেন। ‘হিতৗল' তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ। এতে তিনি বিশ্ব-বহ্মান্ড ও সাঁওতাল বা খেরওয়াল জাতির সৃষ্টি তত্ত্বের কাহিনী ছন্দে ছন্দে লিপিবদ্ধ করেছেন। এটি একটি ধর্মীয় বই। এছাড়াও ধর্মীয় গানের বই 'বাহা সেরেঞ' ও 'বাখেঁড়' নামে একটি পূজাস্তোত্রও তিনি লিখে গেছেন। শেষ নাটকটি তিনি ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ অবলম্বনে লিখেছিলেন। এই ‘সিদো-কানহ-ছল' নাটকটি ১৯৭৮ সালে লিখে যন্ত্রস্থও করেছিলেন, কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক তখন প্রকাশিত হয়নি। পরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র স্বর্গীয় সিদলাল মুর্মুর সম্পাদনায় বইটি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়।
পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু মানুষকে ভালবাসতেন। স্বাভাবিক-ভাবেই তিনি সাঁওতাল সমাজকেও ভালবেসেছিলেন। তাই সাঁওতাল সমাজের অবক্ষয় দেখে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষয়িষ্ণু সাঁওতাল সমাজ যাতে তার সমস্ত রকম কালিমা ঘুচিয়ে আবার শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তারই জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তাই সামাজিক ও নৈতিক উন্নতির কথা স্মরণ রেখে ন্যায় ও ধর্মভিত্তিকে লোকশিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রকৃত কল্যাণধর্মী ও গঠনমূলক সাহিত্য সৃষ্টি করেন। গানের মৌলিক সংকলন, কাব্যগ্রন্থ কিংবা যাত্রাপালা সব কিছুতে তারই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষতঃ তাঁর রচিত গানগুলি দার্শনিক তত্ত্বে পরিপূর্ণ এবং চিরন্তন সত্যের আধারে বিধৃত। সেইরকম কিছু গান এখানে তুলে ধরা হল। যেমন-
১) অল মেনাঃ তামা রড় মেনাঃ তামা
ধরম মেনাঃ তামা আমই মেনাম।
আলেম আৎ লেরে রডেম আৎ লেরে
ধরমেম আৎ লেরে আমহুঁম আদর।
তর্জমা-
তোমার লিপি আছে, তোমার ভাষা আছে,
তোমার ধর্ম আছে বলেই তুমি আছ। লিপি যদি হারাও তো তুমিও হারিয়ে যাবে।
2)অকয় হড়াঃ মেৎ বীনুঃ—উনি হড়াঃদ দাদা
মার্শাল বীনুঃ আন,
অকা জীতি রেনাঃ—অল বানুঃ আনাং অনা জীতি রেনাঃ দাদা মার্শাল বীনুঃ আন।
তর্জমা-
যার চোখ নেই—সেই লোকটি যেমন আলো কি তা জানে না,
যে জাতির লেখা নেই—সেই জাতি জ্ঞানের আলো দেখতে পারে না।
3)যাহাঁতিনীঃ হুডিঞ বেহঃ, যাহাতিনীঃ নিধনী রেহ
নওয়া জেগেতরে-
আকাহঁ বিন লীকতিদ বানুঃ আনা।
জিনিস বড়ায় ঠিকী কাতে, কীমিরে লাগাও লেখান ছি-য়ানার হুঁ নায়ানঃ আ।
তর্জমা-
যত তুচ্ছই হোক, যত নিকৃষ্টই হোক এ জগতে কোন কিছুই নিষ্প্রয়োজন নয়।
তার সঠিক গুণ জেনে কার্যে যথার্থ প্রয়োগ করলে সেটাই আকর্ষক হয়ে ওঠে।
8) অল তাব ঢিলাও-অঃ খান
আব গে ঢিলাও-অঃ আ
হিরিজ পাসির কাতেব আদঃ আ। অলদ বারাহি কানা
আবয় তল দহ বনা মার্শাল হরতেয় অর ইদিবনা।
তর্জমা অলচিকি যদি অবহেলা করি নিজেদেরই অবহেলা করা হবে টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হতে হবে।
অলচিকিই সুবন্ধনী হবে
আমাদের ঐক্য আনবে
উন্নতির পথে টেনে নিয়ে যাবে।
ধরম রেয়াঃ হাঁড়ি-ঞ দবন এইগে
অর্থীওড়ি ঞুদ মেনখান বাংগে বোগেয়া।
জীউয়ীরেঃ হড়মরে বিষ লেকায় কীমি জখা
জীনিজ রান লেঃ ঞুগে বোগেয়া।
তর্জমা
ধর্মের হাঁড়িয়া যদিও পান করি
বেহিসেবী হাঁড়িয়া পান কিন্তু মোটেই ভাল না ।
শরীরে বিষের মতো কাজ করে
ঔষুধের মতো অল্পমাত্রায় পান করা উচিত।
নওয়া জীবন, রাশি জীবন—
নওয়া জীবন আদ বাম জ্ঞামা।
এনেজ জংমে, সেরেঞ জংমে, রাস্কৗ জংমে
— নওয়া জীবন আদ বাম জ্ঞামা।
তর্জমা
এ জীবন—পরিপূর্ণ জীবন
এজীবন আর ফিরে পাবে না ।
নাচ, গাও, জীবন আনন্দময় কর—
এ জীবন আর ফিরে পাবে না।
৭) যুদী যুদী পনত রেহ আব মেনাঃ বন দাদা আব লেকা গে,
রড়হ তাব মিগে রাড়হঁ তাব মিগে
চেদাঃ বাব মিদঃ দাদা
অলঃ পাড়হাওরে।
তর্জমা-
পৃথক পৃথক রাজ্যে থেকেও
আমরা আমাদের মতোই আছি,
আমরা একই ভাষা বলি
আমরা একই ভাবনা ভাবি
তবে কেন আমরা এক হব না লেখাপড়ার ক্ষেত্রে।
অলগুরু পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু একাধারে প্রকৃতিপ্রেমী, মানবপ্রেমী, ধার্মিক, সংস্কৃতিপ্রেমী ও মাতৃভাষাপ্রেমী ছিলেন। তিনি তাঁর সৃষ্টি ও নানাবিধ কার্যকলাপের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তা, গবেষণা, সাহিত্য সৃষ্টি ও নেতৃত্ব সবই অতুলনীয়, আমাদেরকে অভিভত করে। এই বহুমুখী প্রতিভার জন্য তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি বহু সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। উড়িষ্যার আদিবাসী মহাসভা তাঁকে “গুরু গমকে” উপাধিতে ভূষিত করেন। তৎকালীন আদিবাসী নেতা জয়পাল সিং তাঁকে “পণ্ডিত” নামে অভিহিত করেছিলেন। ধুমকুরিয়া রাঁচী নামক এক সংস্থা তাঁকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ্ অধ্যাপক মার্টিন ওরেন্স পণ্ডিত মুমুকে “আধ্যাত্মিক গুরু” বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য সাধনা এবং ভাষা সাহিত্য বিকাশে সমর্পিত জীবনের জন্য উড়িষ্যা সাহিত্য একাডেমী ১৯৭৮ সালে তাঁকে “ফাউণ্ডার অব সানতালী ল্যাংগুয়েজ, লিটারেচার এ্যাণ্ড ইনভেনটর অফ অলচিকি স্ক্রীপ্ট” সম্মানে ভূষিত করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাঁকে সম্মানিত করেন। ১৯৭৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার অন্তর্গত কেঁদবনা গ্রামে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশে পশ্চিমবাংলার মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাশয় গুরুগমকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুমুকে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য তাম্রফলক ও মানপত্র দিয়ে সম্বৰ্দ্ধনা জ্ঞাপন করেন।
“জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে”। পণ্ডিত মুর্মু এক মহান ব্যক্তিত্ব হলেও মানুষ হিসেবেই জন্মে ছিলেন। তাই তিনিও মৃত্যুকে এড়াতে পারেন নি।
১৯৮২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী সকাল ৮টার সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মহান ব্যক্তিত্বের পরলোক গমনে সেদিন সাত সকালেও রায়রংপুর এলাকায় অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার আদিবাসী সমাজ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। সমগ্র সাঁওতাল সমাজ কিন্তু তখনও জানতে পারেননি যে তাঁদের “গুরু গমকে” আর তাঁদের মাঝে নেই। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ১৯৮২ সালে সন্ধ্যাবেলায় যখন আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের সাঁওতালী অনুষ্ঠানে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হয়, সেই সংবাদ শুনে সমগ্র সাঁওতাল সমাজ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। এই শোক ভুলবার নয়, তবুও অবশ্যম্ভাবী সত্যকে মেনে নিতেই হয়। তিনি যে পথ দেখিয়েছেন, যে সত্যের সন্ধান দিয়েছেন, তার জন্য সাঁওতাল সমাজ চিরকাল তাঁর অভাব অনুভব করবেন।
তাঁর আদর্শকে তাঁরা গ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রদর্শিত পথকেই তাঁরা জাতিসত্ত্বা ও ঐতিহ্য রক্ষার একমাত্র পথ হিসাবে স্বীকার করেছেন। তাঁরা বুঝেছেন, এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। বিপথে গেলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবেই। তাই যতদিন যাচ্ছে সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর মানুষের হৃদয়ে তিনি আরও বেশী জায়গা করে নিচ্ছেন। সত্যিই তিনি সাঁওতাল সমাজের জাতীয় গুরু। তিনি পণ্ডিত, অলগুরু এবং গুরুগমকে। এই বিশেষ অভিধাগুলি শুধু তাঁর ব্যক্তিত্বেই ব্যঞ্জিত। আদর্শ এবং অসাধারণ কল্যাণমূলক কৃতিত্বের জন্য তিনি সাঁওতাল সমাজ তো বটেই সবার কাছে প্রাতঃস্মরণীয় এবং চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
0 Reviews