সাঁওতাল সমাজ তত্ত্ব

সাঁওতাল সমাজ তত্ত্ব

Size

Read more

 সাঁওতাল সমাজ তত্ত্ব




See Video






সাঁওতাল জাতির সমাজ সংস্কৃতি উৎসব অনুষ্ঠান মূলতঃ ধর্মভিত্তিক। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যা আছে দেহতত্ত্বে তা আছে সমাজতত্ত্বে, ভিতরের সাথে সম্পর্ক রেখে বাইরের কর্ম। এ মানব জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করা, এ জীবনকে মহাজীবনে পরিণত করা এই লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য রেখে হাপড়ামরা সমাজের কাঠামো ও সংস্কৃতি তৈরি করলেন। মানব দেহ যেমন মন-আত্মা পঞ্চ ইন্দ্রিয় ষড় রিপু দ্বারা পরিচালিত হয় তেমনি এই সাঁওতাল সমাজও মন জিউয়ীর বা আত্মার প্রতীক মানজিউয়ী—মানজিহি—মাজহি— বা মাঝি হলেন গ্রামের প্রধান আর গ্রামের পাঁচজন মঁড়েক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। নারীরা হলেন ষড় রিপুর প্রতীক তুরুইক বা ছয়জন মানবদেহের নক্সাটা সমাজদেহে বিদ্যমান। এই সমাজ ও সংস্কৃতির তত্ত্বকে জানা অর্থে আপন তত্ত্বকে জানা। সাঁওতাল জাতির মানুষ এরূপ সমাজ সংস্কৃতি পন্থাকে অনুসরণ করে আপন স্বরূপকে উপলব্ধি করে সহজ সরল উদার প্রাণ জীবনযাপন করে এই মানব জনমকে সার্থক করে গেছেন। এই পবিত্র সাঁওতাল সমাজের নিয়ামকরা হলেন মাজহি, নায়কে, গডেৎ ও পারানিক। এরা দেব তুল্য মানুষ। সমাজে এদের আসন সবার উঁচুতে।

মাজহি—যিনি মানবদেহের মাজ ও সার তত্ত্বকে চিনিয়াছেন, যিনি মানবকে মঞ্জ বা সুন্দর (আত্মার) জীবনের পথ দেখিয়ে দিতে সক্ষম এই রূপ আত্মজ্ঞ ব্যক্তিই হলেন মাজহি। সাঁওতাল সমাজের মাজ বা সার মূল স্তম্ভ। এক কথায় মানবদেহের মাজ বা সার সত্য হচ্ছে মন জিউয়ী বা আত্মা। যিনি এই মন জিউয়ী বা আত্মাকে জানিয়াছেন প্রকৃতপক্ষে তিনিই হলেন মাজহি পদে আসীন হইবার উপযুক্ত ব্যক্তি। কারণ মনই শোক-তাপদাতা শান্তি-অশান্তি বন্ধন ও মুক্তির একমাত্র কারণ, অন্য কেউ নয়। মনই সর্বকর্মের উৎস। মনের মধ্যেই স্বর্গ ও নরক, ভালো-মন্দ, পাপ-পূণ্য। মনই মানুষকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করায়। মনই শত্রু-মিত্র বিচারশীল হয়ে মনের বিচিত্র রূপ তোমাতেই দেখতে পাবে। যার যেমন মন তার তেমন কর্মও হয়ে থাকে অর্থাৎ 'যার যেমন মতি তার তেমন গতি' হয়ে থাকে। মনকে যিনি জানেন না প্রকৃতপক্ষে তিনিই মূর্খ। নিজের দোষ দেখে অপরের গুণ শ্রবণ করবার রুচি জন্মাতে হবে—নতুবা আত্মোন্নতির আশা নাই। মনের হিংসা, ক্রোধ, দ্বেষাদি-কেই মনের ময়লা বলে, এটাকেই মনের আগুন বলে। এর প্রভাবেই অসংখ্য কু-সংস্কার জন্মে। এই আগুন কু-সংস্কার মন কিছুইতে নিজের দোষ দেখতে পায়না। আর তার ফলে নিজেরই অধঃপতন হয়। মনের বাহ্যিক রূপ হল কর্ম। এই কর্ম দেখে মানুষের মনের পরিচয় পাওয়া যায়। কাজেই মনের মধ্যে নিয়ত বিচার থাকা চাই। বিচার শূন্য হয়ে কর্ম করলে নিজেকেই অশান্তির কবলে পড়তে হয়। যিনি মনের রূপকে জানেন তিনি সবকিছুই জানতে ও বুঝতে পারেন আর নিজ মনকে সহজে আত্মতত্ত্বের দিকে নিয়ে যান। হিতাকাঙ্খী হয়ে সমাজে বিচরণ করেন।

মাজহি— হলেন গ্রামের মালিক। সবাইকে সন্তানের মতন ভালবাসেন। তাই তিনি মাজহি বাবা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন ব্যক্তির সমাজ জীবনে যা যা ক্রিয়াকর্মাদি সমস্তই মাজহি বাবার দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে। যেমন—জন্ম ছাটিয়ার (নামকরণ), বিবাহ, ভাণ্ডারা (মৃত্যুতে) ইত্যাদি। অন্য গ্রাম হতে কোন ব্যক্তি আসলে তাহার বসবাস বাস্তু-ভিটা বিষয়ও মাঝি বাবার অনুমতি ছাড়া হয় না। মাজহির অনুমতি ছাড়া কেউ শিকার দরবারে যেতে পারবে না। কারণ মাঝির কাছে সেই নিমন্ত্রণ যদি আসে তবেই সে তার সন্তানদের যাবার অনুমতি দেন। গ্রামের সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মাঝি থানে প্রায়ই বৈঠক বসে। নায়কে, গডেৎ, পারানিকদের নিয়ে তিনি শলা পরামর্শ করেন। গ্রামের সবাইকে সদুপদেশ দেন। গ্রামে কাহারও দুঃখ বিপদ ঘটলে মাঝি বাবার কাছে জানানো হয়। কোন দিন যদি কোন কারণে কেউ ঝগড়া-ঝাঁটি করে সবার সমক্ষে বিচারে দোষী বলে সাব্যস্ত হয় তা হলে তাকে কানমলার মতো পাঁচসিকা বেশী হলে পাঁচ টাকা জরিমানা হিসাবে দণ্ড করা হয়। ইহাই মাঝিবাবার বড় দণ্ড। এইভাবে নিজের গ্রামের সবাইকে সৎ পথে পরিচালিত করেন।

নায়কে—নায়কে স্বচ্ছ ন্যায়ের প্রতীক যার কর্মাদি গ্রামের সবার ন্যায়ের জন্য তিনিই নায়কে। সৎ সরল পবিত্র আচার-আচরণ তার জীবন-যাপন। সাধনায় মত্ত জীবন দৈব ভাবে ভাবিত ঈশ্বর স্মরণ মনন নিয়ে থাকেন। তার হাতে গ্রামের দেবতাদের পূজা অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্যের কর্মাদি সমর্পিত থাকে। তিনি গ্রামের সকল দেবতাদের ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তাহার ঘর-দুয়ার, দেবস্থান—সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকে। পূজা সামগ্রীতে সাজানো থাকে। গ্রামের মানুষকে ন্যায়-এর পথ দেখিয়ে দেন এবং সেই সাথে সুন্দরকে চিনিয়ে দেন। যার প্রভাবে এ জীবন সুন্দর, মধুময় হয়ে ওঠে। নায়কে হলেন সুন্দরের পূজারী, পারেন মানুষকে সুন্দর জীবন দিতে।

গডেৎ—গডেৎ হলেন মাঝি বাবার দূত। মাঝি বাবা যা বলেন গ্রামের সবার ঘরে তিনি সেই খবর পৌঁছে দেন। গ্রামের যে কোন প্রয়োজনে মাঝিবাবা গোড়েৎকে হুকুম দেন গ্রামের সবাইকে সমবেত করার জন্য। তারপর শলাপরামর্শ করে কাজের বিবৃতি দেন। গ্রামের কারও দুঃখ, বিপদ বা মৃত্যু ঘটলে কিংবা বিবাহ, নামকরণ লত্তা (ছাটিয়ার) অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হলে প্রথমে মাঝিবাবার কাছে বলতে হয়। তারপর সেই খবর মাঝি বাবা গড়েৎ-এর মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেন। এই সমস্ত শুভকর্ম যখন যার বাড়িতে হয় এ কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গড়েৎ সেই স্থান পরিত্যাগ করতে পারেন না। হাঁকে ডাকে সব সময় তার প্রয়োজন আছে। গড়েৎ ছাড়া সমাজের কোন কাজ সুসীর বা সুসম্পন্ন হয় না। রাতে-ভিতে, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও সবার দোরে দোরে গিয়ে খবর দিতে হয়। গড়েৎ হলেন মাঝি বাবার ডানহাত বামহাত।

পারানিক –বিচারে পারঙ্গম। যিনি অন্যায় কর্মের উৎসস্থল সঠিকভাবে নিরুপন করতে পারেন এবং সেই দোষযুক্ত অন্যায় অপকর্ম হতে কিভাবে বিরত থাকা যায় এইরূপ জ্ঞানদানে সক্ষম পরমজ্ঞানী ব্যক্তিকেই পারানিক বলা হয়। ইনি মানুষের ভুল দোষকে দেখিয়ে দিয়ে সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারেন বলেই পারানিক। এর কাছ থেকে সমাজের মানুষ সংসার সাগর হতে উত্তীর্ণ হবার পারানি পায়। গ্রামের মানুষ কেহ অন্যায় দোষ করিলে পারানিক-এর উপর বিচারের ভার পড়ে। তিনি কখনও অসত্য-অধর্ম কথা বলেন না। সবাইকে সমান চোখে দেখেন। নিরপেক্ষ ভূমিতে অবস্থান করে বিচার করেন। বিচারের উদ্দেশ্য থাকে অশান্তি দূর করে শাস্তি আনয়ন। তিনি গ্রামের সবার কাছে মানব মনের বিচিত্র রূপের কথা বর্ণনা করেন। মনই মানুষের সব। বস্তুতঃ এই বিশ্বের যাবতীয় ঘটনা এই মন হতে উৎপন্ন হয়ে বাহিরে দৃষ্ট হয় অর্থাৎ এ সংসার জীবনে যা কিছু ঘটে তা মানুষের আপন মনের অবস্থা মাত্র। এই বিচার শক্তিটা মানুষের মনে ধরিয়ে দেন। গ্রামের মানুষও তার আদেশ পালন করে নিজের দোষ ধরতে পারেন এবং সেই দোষ হতে পরিত্রাণ পাবার জন্যে যত্নবান হন। গ্রামের মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দে শান্তিতে বসবাস করেন।

ধর্ম বৃক্ষ—ধর্ম সমাজের জীবন। সমাজের মানুষকে সুনিয়মে সুশৃঙ্খলায় রাখে। সত্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ জগতে আর কিছু নাই। সত্যতেই ঠাকুর মারাং বুরুর আবাস ভূমি। সত্যাশ্রয় মানুষ বিচারবান হন। নেতি নেতি বিচার-আচারের ফলে সহজ সরল, উদার পরাণ শোভন ও মর্যাদা সম্পন্ন হয়। সাঁওতাল জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতির বিশাল সৌধটি এইরূপ বিচারবান মহাপুরুষদেরই সৃষ্টি এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সংস্কৃতিগুলি জাতির জীবন বেদ। স্বচ্ছ জীবন চলার পথে যাবতীয় কর্মানুষ্ঠান সেই পরম সত্য ঠাকুর মারাং বুরু জাহের আয়োকে উপলব্ধি করার আরাধনা মাত্র। সাঁওতাল জাতির মহাপুরাণ জমসিম বিন্তিতে দেখা যায় হাপড়াম কড়া দুঃখ কবলে পড়লে পরে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্ম অনুসন্ধানে বাহির হন। দীর্ঘ দশ কুড়ি বছর কঠোর তপস্যা সাধনা করে ধর্মকে সত্যকে উপলব্ধি করেন। সত্যকে উপলব্ধির জন্য যে সব প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাহা অতি চমৎকারভাবে মীমাংসা করে গেছেন। 


প্রথমে তারা ‘হেচং বাংচং' অর্থাৎ সংশয়-এর নিকট গেলেন এবং সেখানে দশ-কুড়ি বছর ‘বিচার-আচার' করলেন কিন্তু সবই ‘হেচং বাংচং’ বা সংশয়ে পরিণত হল। এরপর তাঁরা ‘লাবাড় আতনা' এড়ে আতনাঃ বৃক্ষ অর্থাৎ মিথ্যা আসন বৃক্ষের নিকট গেলেন এবং সেখানেও সব কথা লাবাড় অর্থাৎ অনর্থ মিথ্যা হয়ে গেল। এরপর তাঁরা লেপেচ্ তেরেল বা চপল কেন্দু বৃক্ষের কাছে গেলেন, সেখানেও দশ-কুড়ি বছর বিচার-আচার করলেন কিন্তু সব কথাই অন্তঃসার শূন্য মিথ্যা হয়ে গেল। এর পর তাঁরা ‘পেটের বাড়ে বুটা' বা 'পেঁচালো বট বৃক্ষের নিকট গেলেন, সেখানেও সব কথা পেঁচিয়ে ফেঁচিয়ে গেল বা পেটের জেটের হল। এরপর তারা ‘খোদে মাতকম বুটী' বা 'ক্ষুদে মহুয়া বৃক্ষের তলে গেলেন, সেখানে তাদের সব কথা খুদুর বুদুর বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্লেষণ হল। শেষে ‘সারি সার-জম বুটা' বা সত্য সার শাল বৃক্ষের নিকট গেলেন। সেখানে বিচার-আচার করার পর সব কথা সত্য হয়ে গেল। ধর্মকে উপলব্ধি করল এবং সেই সত্য শাল বৃক্ষতলেই 'মারাং বুরু জাহের আয়োর' পূজা আরম্ভ করল।

এখন জমসিম বিন্তীর উপাখ্যানে এই বৃক্ষগুলির অন্তরালে ধর্মের কি কি ভাব লুক্কায়িত আছে তাহা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। শুধু কথায় যেমন চিড়া ভিজে না তেমনি শুধু বিচারে ধর্ম দাঁড়ায় না। বিচারের পর আচার বা আচরণের মধ্যেই ধর্মের পূর্ণতা আছে। অর্থাৎ যাহা আচার করবে তাহা প্রথমে বিচার করে দেখবে সেটা ভাল কি মন্দ হবে। এই উদ্দেশ্য রেখে বিচার-আচার' কথাটি বলা হয়। সেখানে বিচার- আচার নাই তাকে ধর্ম বলে না । বিচার-আচারহীন মানুষ পশু তুল্য। এখানে লক্ষ্যের বিষয় মানব মনে যেসব ভাব থাকে বৃক্ষের নামগুলিও সেইরূপভাবেই নামকরণ করা হয়েছে।

‘হেঁচং বাংচং’ : শব্দের বঙ্গানুবাদ হল সংশয় বা সন্দেহ। এটা এরূপ অথবা এটা এরূপ নয়—এই উভয় পক্ষপাতী জ্ঞানকে সংশয় বা সন্দেহ বলে। কিংবা হ্যাঁ এটা ঠিক পরক্ষণেই না এটা ঠিক না এরূপ ভাবা। সঠিক জ্ঞানের অভাবের অবস্থাকে হেচং বাংচং বা সংশয় শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। সঠিক জ্ঞান হলে হেচং বাংচং বা সংশয় থাকে না। মানব মনের সঠিক জ্ঞানের অভাবের অবস্থাকে সংশয় বলে। সত্য সন্ধানী বা ধর্ম সন্ধানী হাপড়াম কড়া মনে প্রথমে এরূপ দশা হয়েছিল বা এরূপ হেচং বাংচং সংশয় দেখা দেয়। আমরা হিন্দু ধর্মের গীতা গ্রন্থেও এরূপ দেখতে পাই। অর্জুনের মনে এরূপ সংশয় দেখা দেয়, কোন্‌টা ধর্ম কোটা অধর্ম বুঝতে না পেরে শ্রীকৃষ্ণের নিকট শরণাপন্ন হন এবং এই সংশয় থেকে পরিত্রাণের জন্য বার বার শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন আর শ্রীকৃষ্ণও তার উত্তর দান করে অর্জুনের সংশয় নিরসন করেন। এই সংশয় নিরসন করতেই বিরাট ধর্মগ্রন্থ মহা ভারতের সৃষ্টি হয়।

এই হেচং বাংচং বা সংশয় মানব জীবনের মহা শত্রু। সংশয়যুক্ত মন দ্বারা কেউ কোন দিন শান্তি পায় না, কি সংসার জীবনে কি ধর্ম জীবনে। প্রতি নিয়ত বিচার সাধনার দ্বারা সংশয় মনকে ছিন্ন করতে হয় তবেই সংসারে শান্তি পাওয়া যায় ও ধর্মকে লাভ করা যায়।

‘এড়ে আতনা–লাবাড় আতনা' : শব্দের বঙ্গানুবাদ হল 'মিথ্যা আসন লোভের আসন'। মানবের মন যখন মিথ্যার চিন্তায় পরিপূর্ণ থাকে তখন সেই অবস্থাকে হাপড়াম কড়া মিথ্যা আসন বা এড়ে আতনঃ নামে অভিহিত করলেন। মানবের মন যখন বিবেক শূন্য হয়ে শুধু রূপ লোভের কামনার মত্ততা ও তৎজনিত প্রমাদ অবস্থায় বিচরণ করেন হাপড়াম কড়া সেই লোভ-লালসার মনকে নাম দিলেন 'লাবাড় আতনাঃ” বা ‘লোভের আসন'। মানবের এই অবস্থাটা খুবই নিম্নস্তরের। এই আপাত রমণীয় অবস্থা মানবকে অতিক্রম করতে হবে।

লেপেচ তেরেল : শব্দের বঙ্গানুবাদ হল 'চপল কেন্দু বৃক্ষ'। এই লাপাঃ চাপাঃ বা চপলতার স্তরে মানব মন যখন অবস্থান করে তখন সে শুধু লফর লফর কথা বলে যা অসার অন্তঃসার শূন্য শুধু বাক্যাড়ম্বর মাত্র। মানব মনের এই অবস্থাকে হাপড়াম কড়া ‘লেপেচ তেরেল বুটী বা চপল কেন্দু বৃক্ষ' বলে উদাহরণ দিলেন। এইরূপ শুধু কথায় ধর্মকে পাওয়া যায় না।

‘পেটের বাড়’: শব্দের বাংলা অর্থ হল ‘পেঁচালো বট’। মানব মন যখন ক্রোধ, হিংসা, ঈর্ষা-দ্বেষাদি পেঁচালো বুদ্ধির আবাসস্থল হয় এইরূপ কুটিল জটিল কপটতা সংকীর্ণ অসরল চিত্তের উদাহরণকে পেটের বাড়ে বা ‘পেঁচালো বট' বৃক্ষ বলা হল। মানব মনের অজ্ঞান অবস্থার ইচ্ছা আর এক বড় উদাহরণ। এই কপটতা অসহজ ভাব- এর মধ্যে ধর্মকে পাওয়া যায় না।

খোদে মাতকম : শব্দের বঙ্গানুবাদ হল 'ক্ষুদে মহুয়া'। মানব মনে যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুলচেরা বিচার জন্মালো, এইরূপ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মবিশ্লেষণক্ষম চিত্তের উদাহরণকে হাপড়াম কড়া ‘খোদে মাতকম’ বা ক্ষুদে মহুয়া বৃক্ষ রূপে চিহ্নিত করলেন। এইরূপ বিচারজ্ঞানের ফলে সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তির হেতুকে বুঝতে পারল। মনকে জয় করল। ধর্ম সাধনায় এক মুখী হল। ধর্মলাভ বা আত্মা জ্ঞানলাভ যে মানবের সর্বপ্রকার দুঃখ, অশান্তি বা শোক-তাপের হাত হতে মুক্তির একমাত্র উপায়, এ ভিন্ন মুক্তির অন্য কোন পন্থা নাই ক্ষুদ্র মহুয়া বৃক্ষে এটাই স্বতঃসিদ্ধ হল ।

সারি-সারজম বুটী ঃ এই শব্দের বঙ্গানুবাদ হল সত্যসার উপলব্ধির স্থান বা সত্য শাল বৃক্ষতল। এই অবস্থায় মানব তার সার সত্য আত্মাকে উপলব্ধি করেন। এই সত্যকে 

দেখার (Absolute Truth) ধর্মকে জানার সিদ্ধান্তকে সারি সারজম বা সত্য শালবৃক্ষ নামে চিহ্নিত করলেন।

আত্মজ্ঞানই সারি-সার-জম বা সত্য-সার-উপলব্ধি। একমাত্র তত্ত্বজ্ঞানানুসন্ধানকারী ভাগ্যবান সাধকই প্রাণের আকুল আবেগে অন্তর্যামী সত্য সার ঠাকুর জিউয়ীকে দর্শনলাভ করতে সমর্থন হন। জিউয়ী বা আত্মাই এই জ্ঞানের স্বরূপ। এটা বাক্যে প্রকাশযোগ্য নয়। এই জ্ঞান প্রাপ্তির পর এর স্বরূপ যথাযথভাবে দর্শনানুভ করা যায়। এই জন্য এই অবস্থার নাম 'সারি-সার-জম' বা সত্য-সার খাওয়া। অর্থাৎ ধর্মের সত্য সারটা কথার কথা নয়, এটা জম বা খাওয়ার বিষয়। আহার না করে যদি বলা হয় আমি ভোজন করলাম তাতে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় না। ধর্মের সার সত্যটাও সেরূপ। এই সারি সরজম বৃক্ষকে অর্থাৎ আত্মাকে উপলব্ধি করলে এই তত্ত্ব জ্ঞানের মহিমা ও স্বরূপ বর্ণনাতীত। সব মোহপাশ ছিন্ন হয়ে যায়। সংসারের সুখ দুঃখ ব্যাধি জরা মরণ কিছুই তাকে অভিভূত করতে পারে না। তিনি তখন হেসেচে সেকরেচ আনন্দ বা এক অনির্বচনীয় পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকেন। হেসে খেলে সংসারের যাবতীয় কর্ম করেন। তখন তাহার শত্রু-মিত্র, পাপ-পূণ্য, ধর্ম-অধর্ম, শুচি-অশুচি কিছুই ভেদ থাকে না। সবার সাথে সমান প্রীতি দেখা যায়। 'হড় খানগে পেড়া' বা মানুষ মাত্রই আপন এই আত্মীয় ভাব-এ ভাবিত থাকেন। মন যখন সত্যে প্রতিষ্ঠিত হল তখন সেই সত্য শালবৃক্ষের পাদদেশের মূলেই সত্য রূপ আত্মার প্রতীক মারাং বুরু জাহের আয়োর উপাসনা আরম্ভ হল। সত্য শালবৃক্ষের পাদদেশে পূজাদির মর্মার্থ হল পরম সত্য ঠাকুর আত্মার উপাসনা বা আরাধনা করা। যেমন বৃক্ষের মূল দেশে জল সিঞ্চন করলে কান্ড শাখা-প্রশাখা, পত্র-পুষ্পাদি সবই পরিপুষ্ট হয় তার বিভিন্ন অংশে সতন্ত্র জল সিঞ্চ নের প্রয়োজন হয় না। তদ্রুপ ধর্মের মূল হচ্ছে একটাই, শাখা-প্রশাখা অনেক। ধর্মের মূল এই সত্য সার আত্মা বৃক্ষ থেকেই শাখা-প্রশাখার মত বহু ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। এই ‘সারি-সার-জম’ আত্মা বৃক্ষকে প্রতিনিয়ত স্মরণ মনন ধ্যানযোগের দ্বারা যখন উপলব্ধি করবে তখন দেখতে পাবে আপনার মধ্যেই সেই পরম পুরুষ ঠাকুর ঠাকুরান, মারাং বুরু, জাহের আয়ো, মঁড়েক তুরুইক বিদ্যমান। তার অস্তিত্বই আপন অস্তিত্ব। এই সংসার জীবনে হাপড়াম কড়া আত্মা বৃক্ষকেই একমাত্র ধ্যেয়তম বস্তুরূপে পরম সমাদরে লাভের জন্য সতত বিচার আচার করে হৃদয় গ্রন্থির সমস্ত অহংকার সন্দেহ বিদূরিত করে পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ কবিয়া এ জীবনকে মহাজীবনে পরিণত করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে ‘হেচং বাংচং’, এড়ে আতনাঃ লাবাড় আতনাঃ, লেপেচ তেরেল, পেটের বাড়ে, খোদে মাতকম, সারি সারজম বুটা সবই মানব মনের মধ্যে বিদ্যমান। এই শব্দগুলি বা বৃক্ষগুলি মানব মনের এক একটি ভাবের কথা বলে। চিন্তার স্তরভেদে মনের অবস্থার  গুণগত তারতম্যকে সহজে বুঝবার জন্য লোক শিক্ষার নিমিত্ত হাপড়াম কড়া চিত্ত ভূমির স্তরকে উপলব্ধির সংজ্ঞা দেন। আপন মনের স্বরূপকে ধরবার পন্থা। মানব মনে প্রতিনিয়ত জলের বুদবুদের ন্যায় কত চিন্তার উদয় হয়। এ চিন্তারাশি মানবকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার ঠিক ঠিকানা থাকে না। সত্য সাধনায় এই বৃক্ষগুলি সত্যের প্রগতির সহায়ক। এই বৃক্ষগুলি সাধককে এই শিক্ষাই দেয় যে, ধর্মলাভের প্রতিবন্ধকগুলি হল কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা, সংশয়, কপটতা, ঈর্ষা, দ্বেষাদি। এই ভাবগুলি মানবকে অতিক্রম করতে হবে। এসব প্রতিবন্ধক থাকার জন্যই ধর্ম, সত্য, আত্মা অতি নিকটে থাকা সত্ত্বেও মানুষ দেখতে পায় না। এই বৃক্ষগুলি মন্থন করলে বৃক্ষাবৃত উপস্থিত হবে। ধর্ম সত্যকে উপলব্ধি করা যায় এইজন্য শাস্ত্রের এই বৃক্ষগুলিকে ধর্মবৃক্ষ বলা হয়। বিচার করে দেখলে সুদূর প্রসারী ও উন্নততম বিচার চিন্তার এ এক মহান নিদর্শন। মানব মনের অবস্থাগুলিকে গুপ্তভাবে দেখানো হয়েছে। যাহা অন্য ভাষার জ্ঞানীগণ এর মর্মার্থ জানে না। তাই অনেক সময় তারল্য ভাষায় এর ব্যাখ্যা করেন।



0 Reviews