কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু ও তাঁর সাহিত্য ভাবনা

কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু ও তাঁর সাহিত্য ভাবনা

Size

Read more

 কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু ও তাঁর সাহিত্য ভাবনা









কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু ১৯২৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী পুরুলিয়া জেলার দাঁড়িকোডোবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা চরণ কিস্কু দরিদ্র প্রান্তিক চাষী ছিলেন। তাঁর চার কন্যা সন্তান ও একমাত্র পুত্র সন্তান সারদাপ্রসাদ কিস্কু । বাবা দরিদ্র হলেও লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ টান ছিল। ১৯৩৮ সালে জারোবাড়ি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সারদাপ্রসাদ কিস্কুর হাতে খড়ি হয়। ১৯৪০ সালে বড়গেড়িয়া উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথম হয়ে বাঁকুড়া জেলার রানীবাঁধ মিডল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। বাড়ী থেকে অনেক দূর হওয়ায় রানীবাঁধ পার্শ্ববর্তী লালগোড়া গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়ী থেকে পাস করে ১৯৪৩ সালে খাতড়া হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। “মেরিট স্কলারশিপ” পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় বোর্ডিং-এ থাকার সুযোগ হয়েছিল এবং তাঁর স্কুলের বেতনও লাগল না। সারদাপ্রসাদ কিস্কু আগাগোড়া খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করে উত্তীর্ণ হতেন। স্বল্পভাষী, নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন। সকল মাস্টার মহাশয়রা তাঁকে ভালবাসতেন। ১৯৪৮ সালে খাতড়া হাইস্কুল থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। তাই এস. সি-তে বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজে ভর্তি হলেও অভাব অনটনের জন্য পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

১৯৫০ সালে বান্দোয়ান হিন্দি শিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তিনমাসের ট্রেনিং নেওয়ার পরই জামতোড়িয়া সিনিয়র বেসিক স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান। ১৯৬২ সালে কংগ্রেস দলের প্রার্থী হয়ে বিধানসভায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য স্কুলের শিক্ষকতা ছাড়তে হয়। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আবার শিক্ষকতা আরম্ভ করেন বাড়ী থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে সিংরাইডি গ্রামে। ওখানে দুই বছর শিক্ষকতা করার পর পাশের গ্রাম বড়দহিতে বদলি হন।১৯৭৩ সালে আদর্শ শিক্ষক হিসাবে রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি'র হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৯ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসে চাকরী থেকে অবসর নেন।

তিরিশ দশকে যখন কবি সাধু রামচাঁদ মুরমুর “দেবন তিগুন আদিবাসী বীর” গান সাঁওতাল জাতিদের মধ্যে তোলপাড় করছে, “আদিবাসী মহাসভা” নামে সংগঠনে সাঁওতালরা একত্রিত হচ্ছে, অপরদিকে চল্লিশ দশকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুর “বিদু চাঁদান’ “খেরওয়াল বীর” “দাড়েগে ধন” প্রভৃতি যাত্রাপালা মঞ্চ স্থ হচ্ছে, ঠিক এই সময় কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কুর আবির্ভাব। ১৯৩৯ সালে জরোবাড়ী স্কুলে শিশু সারদাপ্রসাদ কিস্কু পড়াকালীন সর্বপ্রথম রাজেন্দ্র নাথ মাঝির (হেমব্রম) একটি ছাপা বই চোখে পড়ে। সেই বইয়ের শুধু একটি লাইন মনে পড়ে “সিউড়ি সাগাৎ খেনচের আতে” “শিশু সারদাপ্রসাদ কিস্কু'র মনে ভীষণভাবে রেখাপাত করে। ১৯৪২ সালে সুনারাম সরেন- এর “মার্শাল ডাহার” বই থেকে তাঁকে একটি কবিতা পাঠ করানো হয়েছিল। সে সময় উড়িষ্যার সুনারাম সরেন, সুন্দরমোহন হেমব্রমরা গান গেয়ে গেয়ে তাঁদের বই বিক্রি করতেন। এরকমই একটি কবিতা মনে পড়ে-

অল বীঞ বাড়ায়তে

হাসাঞ মামাঃ কানা ডিগির ডিগির

আয়ো বায় শিকীউ লিপিঞ

বাবা বায় পাড়হাও লিপিঞ

নাওয়া জিয়নদ তিঞ কষ্টঃ লাগিদ।

সারদাপ্রসাদ কিস্কু উল্লেখ করেছেন— “তারপরে আমি খাতড়া হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করলাম। আর বাড়ী থেকে উৎসাহ পেলাম বলে বিষ্ণুপুর কলেজে ভর্তি হলাম। বিষ্ণুপুর আসা-যাওয়ার পথে আমি খাতড়ার পাশে গুইহানালা গ্রামে আমার এক বন্ধু নবীন বেসরার কাছে থাকতাম। তার বাড়িতে একদিন সন্ধ্যাবেলায় সাধু রামচাঁদ মুরমুর “সারি ধরম সেরেঞ পুঁথি” আমাকে দেখাল। আমি অবাক হয়ে পড়তে লাগলাম। দেখলাম বইয়ের মধ্যে আগাগোড়া ছন্দ মিল করে লেখা আছে। ছন্দের মিল খুঁজে পেলাম। ওই সময়ের মধ্যে আমিও ছন্দ মিল করে একটি গান লিখে ফেললাম। সেদিন থেকে মনে স্থির করলাম কি গান কি কবিতা ছন্দ মিল ছাড়া লিখব না।”

সেদিন থেকে সারদাপ্রসাদ কিস্কু সাঁওতালী কাব্য সাহিত্যে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে থাকলেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় বিহার সরকার থেকে প্রকাশিত “হড় সম্বাদ” পত্রিকাতে। তিনি সাধারণত গান ও কবিতা লিখতে ভালবাসতেন।

তবু তাঁর লেখায় সাহিত্যের বিভিন্ন দিক অতি সহজে ফুটে উঠেছে। এই জন্য তাঁকে একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে বাঁকুড়া জেলা থেকে মাননীয় ভবতোষ সরেন মহাশয়ের উদ্যোগে “খেরওয়াল আড়াং” নামে সাঁওতালী পত্রিকা প্রকাশিত প্রকাশিত হত। এই পত্রিকায় ছদ্মনাম নেওয়ার প্রসঙ্গে লিখেছেন- “আমি গল্প লেখার লোক নই। বাঁকুড়া থেকে “খেরওয়াল আড়াং” প্রকাশিত হবার সময় পত্রিকার সম্পাদক ভাবতোষ সরেন প্রয়োজন মনে করে আমাকে গল্প লেখার জন্য অনুরোধ করে। ওই পত্রিকায় আমার গান কিংবা কবিতা থাকার কথা। একই সংখ্যায় একজনেরই দুটি লেখা দৃষ্টিকটু লাগত। এছাড়া গল্প লেখার জন্য আমি ছদ্মনাম “টটকো মলং” নিয়েছি। “হড় সম্বাদ” এবং “তেতরে” পত্রিকায় আরো একটি

ছদ্মনাম “পাতাং সুরীই”-এর ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে।

আগেই উল্লেখ করেছি সারদাপ্রসাদ কিস্কুর প্রতিটি গান ও কবিতা ছন্দ মিল আছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ভুরকী ইপিল” প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। তারপর ১৯৬০ সালে “কুহু বাউ”, ১৯৬৭ সালে “গামর্গদার” এবং ১৯৮৫ “লাহা হরের”। এছাড়া গল্প সংকলন “সলম লটম” (১৯৮৮) প্রবন্ধ, “জুউসি অনল মালা” (১৯৯৪), “বিদী বেড়া” ১৯৯৭ এবং অনুবাদ কাব্য “সঙ্গীতিকা” (১৯৯৮)।

সারদাপ্রসাদ কিস্কু শুধু একজন বড় মাপের কবি ছিলেন না, একজন সাঁওতাল সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। ডাইনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর ভূমিকা সর্বাগ্রে উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৪ সালে ডাইনি বিরোধী আন্দোলন ও আইন প্রবর্তন করার দাবী তাঁরই নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতাল সমাজের জন্য অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাঁকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। একশ্রেণীর স্বার্থন্বেষী মানুষ অশিক্ষিত অজ্ঞ সাঁওতালদের বোঝানো হয়েছিল সারদা প্রসাদ কিস্কু সাঁওতাল সমাজ পছন্দ করে না, ঠাকুর-দেবতা, ডাইনি-ভূত বিশ্বাস করে না। এইভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হয়েছিল। সারদাপ্রসাদ কিস্কু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৮৬ সালের ১৩ই মার্চে “হাইপার-টেনশন-কাম- প্যারালিসিস”-এ আক্রান্ত হয়ে শরীরের ডান দিকে সম্পূর্ণভাবে অসাড় হয়ে যায়। তবু বাঁ হাত দিয়ে প্রায় ৮/৯ বছর লিখে গেছেন। শেষের দিকে মস্তিষ্ক কাজ না করায় লেখা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালের ১৮ই মার্চ কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু শেষ নিঃশ্বাস

ত্যাগ করেন। (প্রবন্ধটি ২০০১ সালে 'নিরুপমা মুরমু' ছদ্মনামে প্রকাশিত)





0 Reviews