আদিবাসী প্রথাগত আইন ও নারী

আদিবাসী প্রথাগত আইন ও নারী

Size

Read more

 আদিবাসী প্রথাগত আইন ও নারী









পিতৃতান্ত্রিক অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসী সমাজে একমাত্র কর্মক্ষেত্র ছাড়া অন্য সব জায়গায় মেয়েদের স্থান নগণ্য। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন কি সাধারণ ব্যাপারেও তাদের মতামত গ্রহণ করা হয় না। মহিলা সমাজের সমস্যাগুলির সমাধান পুরুষরাই করে থাকেন এবং তাই মেনে নেয় মহিলারা। পুরুষ শাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় বেশির ভাগ নারীকেই মুখ বুজে নানারকম অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পুরুষেরাও নিজের স্বার্থ, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সমগ্র ব্যাপারটিকে এড়িয়ে যায়। এটা সমাজের কলঙ্ক। আজকের দিনে এ হওয়া উচিত না। বলতে বাধা নেই, আদিবাসী সমাজের মেয়েরা এই প্রাচীন ধারাটি মুখ বুজে মেনে চলেছে বলে তারা পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করলেও সমান সামাজিক মর্যাদা কিংবা ভূ-সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে সমান সুযোগ সুবিধা পায় না।

এর মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথাগত আইনের কথাই সর্বপ্রথম স্মরণে আসে। এটিই আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। এ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলি, আদিবাসী সমাজে আচার, রীতি-নীতিকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে প্রথাগত আইন। এগুলিই আদিবাসীদের সমাজধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আদিবাসী সমাজে এই প্রথাগত আইনের গুরুত্ব অনেক বেশি। তারা এই অনুশাসনের আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। কারণ তাদের সমাজ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনধারাকে মূল্য দেয় বেশি। সমাজবদ্ধ মানুষকে যেমন সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয় তেমন সে সমাজের বাইরে বেরিয়ে আসতেও পারে না। উপরন্তু তাকে নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় ও অনেক সময় অলিখিত কঠিন শাস্তিও মাথা পেতে নিতে হয়। আদিবাসীদের এই সংঘবদ্ধতা যে-কোন সামাজিক গর্হিত কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ তৈরি করে, কখনও-বা প্রতিহিংসা নেওয়ার পথেও এগিয়ে দেয়। সমাজের কোনো ব্যক্তি যদি প্রথাকে অবমাননা করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তিকে সমাজচ্যুত বা একঘরে করে দেওয়া হয়। মোটকথা রীতি বা প্রথা হিসাবে যা প্রচলিত আছে তা কোনোক্রমেই অবজ্ঞা করা যায় না আর এই কারণেই তা আইনের মত দৃঢ় হয়। এই প্রচলিত প্রথাই একদিন আইনের স্বীকৃতি পায়। তাই অনেকেই স্বীকার করেন যে, প্রথা বা রীতিই বর্তমান আইনের জনক।


এখন প্রশ্ন ওঠে, এই প্রথাগত আইনের মূল্য কিভাবে বিচার করা যাবে? এ ব্যাপারে যে বিষয়গুলি তুলে ধরা যেতে পারে সেগুলি হল—

(১) প্রাচীনতা (Antiquity)— দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে এমন প্রথাকে প্রাচীনতার পর্যায়ে ফেলা যায়। দীর্ঘদিন প্রচলিত না থাকলে কোনো প্রথাই প্রাচীনতা দাবি করতে পারে না। প্রথাটি তখন স্বাভাবিকভাবেই অপ্রচলিত

হয়ে যায়।

(২) নিশ্চয়তা (Certainly) – প্রথাটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই ব্যক্ত হবে, তার মধ্যে কোনো অপরিচ্ছন্নতা বা জটিলতা থাকবে না ।

(৩) যৌক্তিকতা (Reasonability) – প্রথাটির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক যে বিষয় নিয়ে তা অবশ্য যুক্তিসঙ্গত হবে।

(৪) নৈতিকতা (Morality) – প্রথাটি নৈতিকভাবে বিচার করে প্রয়োগ না করলে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না ।

প্রথাগত আইনের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল— 

(ক) এই ধরনের আইন জনস্বার্থহানিকর কোনো মানসিকতা সৃষ্টি করে না; 

(খ) প্রচলিত রীতি বা আইনের বিরুদ্ধাচরণ করে না। এসব কারণেই প্রথাগত আইনের সর্বব্যাপী প্রভাব আদিবাসী জীবনে পরিলক্ষিত হয়। দীর্ঘদিনের প্রচলিত প্রথা তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে থাকে এবং কোনো অবস্থাতেই তার ব্যতিক্রমকে তারা ক্ষমা করতে পারে না। অবশ্য এটাও অস্বীকার করা যায় না যে কালের পরিবর্তন বা সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহু প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতালাভের পর নানা আইনকানুন হওয়ার ফলে এবং সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটায় বহু প্রথা, রীতি বা সামাজিক অনুশাসন লোপ পেয়েছে।

যাই হোক, আদিবাসী সমাজে প্রথাগত আইনগুলি রক্ষণ এবং সেগুলি যাতে ঠিকমত প্রযোগ হয় তা দেখার জন্য তাদের নিজস্ব নির্বাচিত পঞ্চায়েত থাকে। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভিন্নভাবে পঞ্চায়েত সদস্যরা নিযুক্ত হন, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই পঞ্চায়েত সদস্যরা বংশানুক্রমে ক্ষমতায় আসেন। গ্রামের উৎসব-অনুষ্ঠানের দিন ধার্য, ঝগড়া-বিবাদ সুষ্ঠুভাবে মিটমাট, সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এই পঞ্চায়েতের কাজ।

এবার আমরা দেখব কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে এইসব প্রথাগত বিধি গুরুত্ব সহকারে মানা হয়। এ বিষয়ে দেখা যায়-

(১) বিবাহবিধির ক্ষেত্রে

(২) উত্তরাধিকারিত্বের ক্ষেত্রে—বাসগৃহের কর্তৃত্ব, সম্পত্তির বন্টন-লেনদেন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার

(৩) সামাজিক কাজ-কর্ম পালনের ক্ষেত্রে

(৪) ধর্ম-কর্ম পালনের ক্ষেত্রে।

বিষয়গুলির বিস্তারিত আলোচনা এই রকম—

(১) আদিবাসী বিবাহে মন্ত্রপাঠের প্রশ্ন নেই। বিবাহ সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে— প্রথমতঃ জনসাধারণের সমক্ষে সিঁদুর দান, মালাবদল ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। দ্বিতীয়তঃ পাঁচজনের সামনে কনের আত্মীয়-স্বজন বরের আত্মীয়দের হাতে কনেকে তুলে দেবে। বিবাহ বিচ্ছেদও পাঁচজনের সামনে হবে।

(২) আদিবাসী সমাজে মেয়েরা সাধারণতঃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। কারণ মেয়েদের অধিকার সামাজিক নিয়ম-কানুন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সম্পত্তির মালিকানা ছেলেদের বংশ থেকে অন্য বংশে যায় না। সেজন্য যার শুধুমাত্র কন্যা সন্তান তার সম্পত্তি দখল করা কিংবা বিধবার সম্পত্তি দখল করার জন্য অনেক সময় তাকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়।

(৩) সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব পঞ্চাযেত সংগঠনগুলিতে নারীদের স্থান নেই অথচ কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার।

(৪) বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েরা পূজা-অৰ্চনায় যোগ দিতে পারে না।

আদিবাসী সমস্ত প্রথাগত বিধি তাদের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু কোনো প্রথাগত বিধিকে আমল না দেওয়ার জন্য আদিবাসীদের সমাজের কিছু কিছু কুপ্রথা— যেমন বরপণের প্রথা কোথাও কোথাও চোরাগোপ্তাভাবে তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। একটা প্রথা মানব সংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট উপাদান, তা কিভাবে এবং কোন্ পরিস্থিতিতে আইনে পরিণত হয়েছে, তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। এজন্যই আজকের দিনে আদিবাসীদের যে কোন আইনগত সমস্যা সমাধানে তাদের রীতিগত আইন-পদ্ধতির মূল্যায়নের বিশেষ প্রয়োজন।




0 Reviews