Read more
সহরায় উৎসবে সাঁওতালী গান
হেমন্তের ঘন কুয়াশাাা, সোনালী রোদের ছটা মালভূমিতে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আদিবাসী তথা সাঁওতাল গোষ্ঠী মানুষের মধ্যে সহরায় উৎসব মাদকতার আমেজ আনতে শুরু করে। মাঠে ধানের শীষে হালকা সোনালী রঙ, নদী-নালা, খাল বিল জলে পরিপূর্ণ। পুকুর এবং ঝিলগুলোতে পদ্ম, শালুকের মেলা। মালভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য অপূর্ব মনোরম, দাঁশায় উৎসব শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাখাল বালকদের বাঁশী ও বেহালাতে সহরায় গানের সুর বাজে মাঠে ঘাটে। বাঁশী ও বেহালার সুর সাঁওতাল মহিলা ও পুরুষ মনকে নাড়া দেয়। বর্ষার জলে ধসে যাওয়া মাটির দেওয়ালগুলোকে নতুন করে সাজানের কাজে লাগে বাড়ির মহিলারা। কাজ আর গুনগুনিয়ে গান সমান তালে চলে।
দিন দিনতে দিন দ চালাঃ
সহরায় দাইনা সেটেরেন
হেসেচ সেকেচ সহরায় দাইনা সেটেরেনারে।
ভিত পিঁড়ী অড়াঃ দুওয়ীর
দেবন পতাও লগন লগন
জেরেড় জলম পাতাও দরে বীঞ তাঁগিয়া ।।
উপরোক্ত গানটিতে দিদি ও বোনের কথোপকথনে বলা হয়েছে সহরায় উৎসবের আর দেরী নেই। এসে গেছে একেবারে দোরগোড়ায় তাই ঘরদোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও দেওয়ালগুলো নানা রকমভাবে সাজানোর কাজ করতে হবে। সময় কোন কিছুর বা কারের জন্য অপেক্ষা করে না।
কালিপূজা থেকে শুরু করে পূর্ণিমা পর্যন্ত সহরায় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । তবে, ছোটনাগপুর ও রাঢ় অঞ্চ লের কিছু কিছু এলাকায় পৌষ মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে শুরু করে পৌষ সংক্রান্তির আগে এই উৎসব শেষ হয়। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের এই সহরায় উৎসবের হাজার হাজার গান থেকে কিছু গানের কথা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
সহরায় দারায় কানদ
দিনিঞ লেখায়া
চাঁদোঞ কয়গেকান জুতীৎ হিজুঃ কান।
চেতে তেদঞ দারামেয়া
চেতে তেদঞ আতাং এ্য
চেতে তেদঞ (২) আতাং দারামে।
গানটিতে বাড়ীর অবিবাহিত মেয়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘সহরায় উৎসবের আনন্দে দিন গুনছে। আকাশের চাঁদ দেখে ভাবছে অমাবস্যা তো ঘনিয়ে এল। কিন্তু কিভাবে সে সহরায় উৎসবকে সাদর সম্ভাষণ জানাবে।'
দেব-দেবীর আরাধনা, পূর্বপুরুষদের স্মরণে পূজা অর্চনার মাধ্যমে পাঁচদিন ব্যাপী দুন্দুভির রবে মুখরিত হয় সাঁওতাল পল্লী। সহরায় উৎসবে মেয়ে জামাই ও ভগ্নী- ভগ্নীপতিদের নিমন্ত্রণের রীতি এখনও বিদ্যমান। কেন না মেয়ে জামাই বা ভগ্নী, ভগ্নীপতিদের অনুপস্থিতি এই উৎসব অনাড়ম্বর মনে হয়। এই উৎসবকে ঘিরে সবার দিদি বোনদেরই ভাই বা দাদাদের কাছে অধিকার বা দাবী থাকে। এই গানের কথাতেই তার প্রমাণ মেলে-
বাহারেদ সহরায় রেদ
নেওতাঞ মেসে মারাং দাদা
ইঞদ দাদা একা বুহিনগে।
বাঞ খজা সনের সাংকা বাঞ
খজা সিলিক শাড়ী গেল মকা সাসাং গাবাও
লুগড়িঞ বাঁদেয়া।
এই গানে বিবাহিত বোনের আর্জির কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিবাহিত বোন দাদাকে জানাচ্ছে বাহা উৎসব, সহরায় উৎসবে তাকে যেন অবশ্যই নিমন্ত্রণ করা হয়। কেন না সে তার একমাত্র বোন। সোনা-দানা বা দামী শাড়ীর প্রতি তার চাহিদা নেই হলুদ রঙা শাড়ী, তাই সে আনন্দ সহকারে পরবে। বিবাহিত বোনের এই আর্তি সত্যিই মর্মস্পর্শী। শুধু তাই নয় বিয়ের মুহুর্তেও দাদার কাছে বোনের আকুল আবেদন মনকে বিচলিত করে—
'নাই পারম গাড়া পারম
আমদ দাদাম গঞে কান
আয়ো বাবা দুলৗড় দরেঞ চিকা হিড়িঞা।
গাতে কুড়ি মায়া দরেঞ চিকী হিড়িঞা।
তুড়ি সুনুম টড়ঃ টড়ঃ
মেদাঃ দাদা জরঃ তিঞ
বোরসে সেঙ্গেল লেকা দাদা জিওয়ী লঃ তিঞ ।
বাহা রেদ সহরায় বেদ নেওতাঞ মেসে মারাং দাদা মড়েসিঞ মড়েঞিদী কুলহিঞ সভায়া।
উপরোক্ত গানটিতে দাদাকে, বোনের আবেদনের কথা বলা হয়েছে— ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে আমার বিয়ে দিচ্ছ কিন্তু আমি মা, বাবার স্নেহ-মমতার, সইদের ভালবাসা ভুলে থাকব কেমন করে। ফোটা ফোটা আমার চোখের জল ঝরে পড়ছে, তুষের আগুনের মত ধিকি ধিকি জ্বলছে আমার প্রাণ। দাদা, বাহা উৎসব সহরায় উৎসবে আমায় নিমন্ত্রণ করতে ভুলবে না। ঐ সময় পাঁচদিন ব্যাপী দিনরাত্রি আমি নাচগানের আসরেই থাকব।'
সহরায় উৎসব। আনন্দ উৎসব। ভাই-বোন-বন্ধু একত্রে মিলিত হওয়ার উৎসব। বিবাহিত মেয়েরা প্রতীক্ষায় থাকে সহরার উৎসবের জন্য। ওই উৎসবের সময় ভাই কিংবা বাবা এসে নিয়ে যাবে। বিয়ের আগে উৎসবের দিনগুলো যেভাবে কাটিয়েছে সে দিনের স্মৃতি ভোলার নয়। তাই বার বার মনে হয়-
তি তালকা রুমুঞ রুমুঞ
জাঙ্গা তালকা বাবাতিঞ কান
আপুঞ বারেঞ তাক গেক দিশীঞ কান।
বাংদ বাংদ বাবায় দারায়
বাংদ বাংদ দাদায় দারায়
ভিতীর অড়াঃ গায়া সান্ডি সিমদ হারুমে।
সহরায় উৎসব সামনে। বিবাহিত মেয়েদের চাপা আবেদনের কথা এই গানের
মাধ্যমে তুলে ধারা হয়েছে। বলা হয়েছে— 'হাত-পা চুলকোচ্ছে নিশ্চয়, বাবা-মা কিংবা ভায়েরা স্মরণ করছে। মনে হয় বাবা অথবা ভাই আমাদের নিয়ে যেতে আসবে। ঘরে যে বিশেষ মোরগটি আছে তুমি বেঁধে ঝুড়িতে চাপা দিয়ে রাখ।’
এতো গেল যাদের বাবা, ভাই, দাদা বাড়ীতে আছে তাদের কথা। কিন্তু যাদের মা, বাবা, দাদা কিংবা ভাই বাড়ীতে নেই তাঁরা তাদের অন্তরের ব্যথা এইভাবেই প্রকাশ করে—
হড়রেন আয়ো বাবা জাড়ি পুরুধুল ইঞরেন
আয়োবাবা বানুঃ কাতিঞা বোরসে সেঙ্গেল
লেকা জিওয়ী লঃ কান।
আয়ো বাবা বাড়ে কিন তাহেন
তিঞ খান দেশ দিশম খনকিন দেওতা কিঞারে
সাগিঞ দিশম খনকিন দেওতা ইদিকিঞ।।
গানটিতে পিতামাতা হারা বিবাহিত মেয়ের আর্তির কথা বলা হয়েছে অনেকের মা-বাবাই তো অনেক বয়স পর্যন্ত রয়েছেন। কিন্তু তার মা-বাবা নেই। তাইতো এই সহরায় উৎসবের সময় মা-বাবার কথা বার বার তার মনে পড়ছে। সহরায় উৎসবের দিনগুলোর জন্য তার প্রাণ কাঁদছে। যদি তার মা-বাবা থাকতো তাহলে দূর-দূরান্তর থেকে এসে তাকে নিমন্ত্রণ করে অবশ্যই নিয়ে যেত।'
নিমন্ত্রণের পালা শেষ। বহু প্রতিক্ষিত উৎসব সহরায় নায়কে (লায়া) মাঝি (মোড়ল) গডেৎ এবং গ্রামের বিশিষ্ট সদস্যদের সহায়তায় গট পূজার মাধ্যমে বরণ করে। পুরুষ ও মহিলা কন্ঠে শোনা যায়।—
উমিন দিনদ আমদ সহরায়
অকা রেদম তাঁহেকান
অকারেদম উকু দানাং লেন।
আব আতো নায়কে দ
আডি গেনায় ভাগেয়া
হাতি লেকান সহরায় দাই নায় ।
এওয়ের অগুকে।।
গানটিতে সহরায় সারা বছরের অন্তর্ধানের কথা নিহিত আছে। কোথায় কি অবস্থায় থাকার পর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আবির্ভাব তারই বর্ণময় এই গানের অবতারণা। সহরায় উৎসব সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সব থেকে বড় উৎসব। তাই এই উৎসবকে হাতির সাথে তুলনা করা হয়েছে।
সহরায় উৎসব পালনে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই। তাই অন্যান্য উৎসবের তুলনায় ব্যতিক্রম এই সহরায় উৎসব। এই উৎসবে পাঁচদিন ব্যাপী দিবারাত্রি নাচ-গানের আসরে সবাই মেতে থাকে। যুবক যুবতীদের এই পাঁচদিন ছাড় দেওয়া হয় তাঁদের ইচ্ছা মত নাচ-গানের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য। কোনও অপরাধমূলক ঘটনা যাতে না ঘটে এই পাঁচদিনব্যাপী নাচ-গানের আসরে তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন জগমাঝি। যুবক-যুবতীরা আনন্দ সহকারে সহরায় উৎসবে মেতে উঠে।
দেনতিঞ আয়োগো কাঁসা করতাল দেনতিঞ
আয়োগো লুমাম শাড়ী ইঞদ
আয়োগো কুলহিঞ ওডোকঃ।
মড়েসিঞ সঁড়েঞিদা জম ঞ দঞ বাগিনা
কুলহি রেগেঞ ঝামার ঝুমুরা।
গানটিতে মায়ের কাছে মেয়ের আবেদনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। মেয়ে তার মাকে জানাচ্ছে তার কাঁসা করতাল এবং শাড়ী যেন তাকে দেওয়া হয় নাচ-গানের আসরে যাওয়ার জন্য। পাঁচদিন ব্যাপী নাচ-গানের আসরে খাওয়া ভুলে সঙ্গ-সাথীদের সাথেই থাকবে।
এই উৎসব সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গৃহ পালিত গরু-মহিষও এই উৎসবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই উৎসব শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকে গরু-মহিষদের ধোয়ান হয়ে থাকে এবং শিঙে তেল দেওয়া হয়ে থাকে। উৎসবের দিন রাত্রে গরু-মহিষের শিঙে তেল ও সিঁদুর লাগিয়ে ধানের শীষের মুকুট পরিয়ে বাড়ীর মহিলারা কুলোতে ধান, দুর্বা, আতপ চাল, সিঁদুর, প্রদীপ প্রভৃতি নিয়ে গরু-মহিষদের চূমাড়া করে। গানটিতে তারই আভাস মেলে-
নাওয়া হাটাঃ আয়োগো কিরিঞ আক্রমে-
ধুবি ঘাস আয়োগো আগু আঞমে।
ইঞ হঞ চালাঃ আয়োগো গাইক চুমাড়া।।
গরুকে ‘চুমাড়ার’ জন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দেওয়ার কথা গানের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। একদিকে গরু ‘চুমাড়ার’ অনুষ্ঠান অন্যদিকে নাচ-গানের আসর থেকে ভেসে আসে—
মড়ে সিঞ মড়ে ত্রিদী
কুলহি রেলে তাঁহেনা
অকয় রেয়াঃ মানা কাথা বালে আঁজমা।
সেদায় সিক কুলহি ধুড়ি
লেবে তেলে লসদা
এনেচ আলে সেরেঞ আলে বালে লাজাঃ আ।।
যুবক-যুবতীরা পাঁচদিন ব্যাপী দিবারাত্রি নাচে-গানে মাতিয়ে রাখে গ্রামের উপর
পাড়া, নাম পাড়া। ঐ পাঁচদিন কারো কোনও বিধি নিষেধকে তারা আমল দেয় না। বিয়ের আগে মেয়েরা যেমন সহরায় নাচ এবং গানে উপর পাড়া, নাম পাড়া তালপাড়া করতো বিয়ের পরেও বাবা-মার কাছে এসে আগের মত নাচ-গানের আসরে যোগ দেওয়াতে কোনও লজ্জাবোধ থাকতে পারে না। বিবাহিত মেয়েরা পুত্রকন্যাদের নিয়ে স্বামীর সাথে বাবা-মার বাড়ীতে আসে। তাদের আগমনে গ্রামের প্রতি বাড়ীতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। গানের কথায়-
বুরু বুরু পারম খন গেলবার বুরু পারম খন
মারাং দাদায় নেওতা আকাদিঞ।
মিৎ কুটি জেল লাগিৎ মিৎ সরা দাকা লাগিৎ
মারাং দাদায় নেওতা আকাদিঞ।।
পাহাড়, নদী পেরিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিবাহিত মেয়েদের কথা এই গানের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে বোনেরা এসেছে দাদার নিমন্ত্রণ পেয়ে সহরায় উৎসবের আনন্দানুষ্ঠানে সামিল হতে। গ্রামের উপর পাড়া, নামপাড়া অঞ্চল ধামসা, মাদল, বানাম, বাঁশী, করতাল, সাড়পা প্রভৃতি বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে ১০/১২ সারিতে মেয়েরা নাচে গানে পাড়া উত্তাল করে। গানের মধ্যে তাঁর চিত্রটা ফুটে ওঠে—
ফালনা করেন জাঁওয়ায় গংকে
তুমদাঃ কিন রুরু কান
আষাঢ় চাঁদো দাঃ লেকাগেকিন
খেনচের বাড়ায় কান।
ফালনা করেন জাঁওয়ায় গংকে
দন আতেকিন রুরু কান
হিসকি ডিগির হিসকি ডিগির
ধুড়ি কিন অটাং কেৎ।
এই গানে সহরায় উৎসবে আসা জামাতাদের আনন্দানুষ্ঠানে সামিল হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে। অমূক বাড়ীর জামাতা মাদল-ধামসার বোল এমনভাবে শরীর দুলিয়ে তোলার চেষ্টা করছে মনে হচ্ছে আষাঢ়ের জলের ঢলের মতো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছলকে যাচ্ছে। এক এক সময় লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে মাদলে তাল দেয়। বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর মাদলের বোলে আকৃষ্ট হয়ে আর স্থির থাকতে পারে না। নাচের আসরে যাওয়ার তোড়জোড় করে এই গানের মাধ্যমে
অড়াঃ খনিঞ ওডোকলেন ছটকারেঞ তিঙ্গুলেন
গাতিঞ তিঞদ তুমদাঃ এ্য রুয়েৎ
কুলহি ধুড়িয়া অটাং আদিঞ দ।
নি সে আয়ো সনাদ নিসে আয়ো মিরুদ
রাস্কৗগেঞ বুঝাও এদ
ইঞহঁ আয়ো কুলহিঞ দাড়ানা।
দিলি বিটি সনা তামদ দিনি বিটি মিরু তাম
দুগো বিটি কুলহি দাড়ান মে।
বিবাহিত মেয়েরা বাবা-মার বাড়ীতে এসে আনন্দে উৎসবে অর্থাৎ নাচ-গানের আসরে সামিল হওয়ার প্রাধান্য পেয়েছে। এই গানটিতে বলা হয়েছে এমনভাবে মাদলের বোল তুলছে তার পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব নয়। তাই সে মায়ের কাছে তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে নাচ-গানের আসরে যেতে চায়। মা, মেয়েকে বাধা না দিয়ে তার নাতি-নাতনিদের তার কাছে রেখে আসরে যেতে বলে মেয়েকে। সহরায় উৎসবে ‘খুন্টাও’ [(গরু মহিষ (কাড়া) খুঁটা] হল আর একটি উপভোগ্য অনুষ্ঠান। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান চলে। দলে দলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। ভগবতী বন্দনা গানের সাথে 'খুন্টাও' অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে ‘খুন্টাও’ অন্যদিকে নাচ-গান আর ভোজন। সবকিছুর সমন্বয়ে সাঁওতালী পল্লীতে সহরায় উৎসব এক নতুন মাত্রা পায়। ভেসে আসে মন মাতানো গান—
নুমিন মারাং রাশি আতো
দাড়া রাকাব দাড়া আড়গো
উকুর সিরিজল আপে অড়াঃদ।
দারা হারা অড়াঃ তালে
আতাং পিন্ডী দু-ওয়ার
আচুর বলঃ দ ছিতী আলে অড়াঃ গে।।
গানটিতে একটি বাড়ীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিশাল এক গ্রামে সিরিজল নামে ছেলেটির বাড়ী এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করে ছিতা নামের মেয়েটি। উত্তরে ছেলেটি জানায় যেতে যেতে সেখানে দেখবে প্রাচীরে ঘেরা বিশাল বাড়ীর সদর দরজার সামনে বসার চালা ঘর ঐ বাড়ীটিই তাদের। নাচ-গানের আসরে প্রথম আলাপ হয় তাদের। দু-জনের দু-জনকে প্রথম আলাপেই ভালো লাগে—
তালা ঞিদী এভেন কাতে খালিঞ গুনিভাবিঃ আ।
আমাঃ কাথাঞ উইহারা
হিডির হিডির মেদাঃ জরঃ আ।
আঁগা তরা বেরেত কাতে কামিঞ দানাদানীঃ আ.
আমাঃ রডিঞ আঁজম লেখান গানিসানিঃ আঞ।
গানটিতে প্রেমিক যুগলের মনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। শয়নে স্বপনে শুধু আলাপচারিতার স্মৃতি। কোনওভাবেই দূরে সরানো যায় না। কোনও কাজে মন লাগে না। একে অপরের গলার আওয়াজ পেলে মন উতলা হয়ে উঠে। যুবক-যুবতীদের সহরায় উৎসব এইভাবেই নাড়া দেয়।
এক যুবক সারারাতে নাচ-গানের আসরে থেকে সকালে বাড়ী ফিরলে তার বৌদি জিজ্ঞাসা করে কোথায় ছিলে সারারাত গানের ভাষায়-
চেতান কুলহি লাতার কুলহি দাঁড়া রাকাব দাঁড়া আঁড়গো তিরয়ো ধাবুম অকা কেদারে ?
রাশি আতো কুড়ি কড়া
আটাল আটাল গেলবার আটাল মেনাঃ ক
তায়ম আটাল কুড়ি তিরে তিরয়োঞ বাগিয়াৎ।
ধুড়ি রেক এর কেদা লেবেৎ তেক লটম কেৎ—
তিরয়ো পাঁজা তেগে হিলি সিমক রাঃ কেৎ।
গানটিতে ঠাকুরপো বৌদির কথোপকথন ব্যক্ত হয়েছে। বৌদি দেবরকে জিজ্ঞাসা করে উপর পাড়া নাম পাড়া নাচের দলে যোগ দিয়েছিলে, তোমার বাঁশী কোথায়? দেবরের উত্তর- বিশাল গ্রামের যুবক-যুবতীর সংখ্যা এত বেশী যে দশবার সারিতে নাচ হচ্ছে মেয়েদের ভীড়ে আমার হাতের বাঁশী মাটিতে পড়ে পদপিষ্ট হয়ে ধুলায় ঢাকা পড়ে যায়। বাঁশী খুঁজতে খুঁজতেই ভোরের মোরগ ডেকে উঠল। সকাল হয়ে গেল। অপরদিকে দাদাকে বোনের আবেদন-
সারি সহরায় উম হিলঃ
চাউরিচ দাদাঞ আৎ আকাৎ-
লুবুই লুবুই চাউরিচ্ দাদা তলাশ কাতিঞমে।
আমগে দাদা জগমাঝি
আমগে দাদা পারানিক
লুবুই লুবুই চাউরিচ্ দাদা তলাশ কাতিক্রমে।
সহরায় উৎসবের প্রথম দিনে আমার চুল বাঁধার 'চাওরিচ' হারিয়েছে দাদা টাসেলটা আমার খুঁজে এনে দেবে। তুমিই তো জগমাঝি, তুমিই তো পারানিক । আমার ‘চাওরিচ' অবশ্যই খুঁজে দেবে।
এগুলো কেবল গানের কথা নয়, বাস্তবেরই রূপ। এইভাবেই সহরায় উৎসব হর্ষ-বিষাদের মধ্যে দিয়ে বিদায় নেয়। তবুও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে এই উৎসব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আবহমান কাল ধরে সাঁওতালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই গানের রীতি আজও প্রচলিত।
0 Reviews