Read more
আদিবাসী জীবনে উলকির ব্যবহার
উলকির ব্যবহার শুধু আদিবাসী নয়, প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সময় জনপ্রিয় ছিল। মানুষ তার দেহকে স্থায়ীভাবে অলঙ্কৃত করার উদ্দেশ্যেই উলকির প্রচলন শুরু করে। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেন, উলকি এই শব্দটি সংস্কৃত “অলঙ্কৃতি” থেকে এসেছে। তিনি উলকির বিভিন্ন প্রাদেশিক নাম দিয়ে দেখিয়েছেন উলকি শব্দের উৎসই অলঙ্কৃতি। যেমন ওড়িয়াতে চিতাকাটা (সংস্কৃত চিত্র-অঙ্কন) হিন্দিতে গোদ্না বা গোদনা বেঁধা ইত্যাদি। ঢাকার দিকে গোদ্দাম গোদানি। তাঁর মতে, “বেঁধা হইতেছে উলকি শব্দের সংস্কৃত মূলের অর্থ— সম্প্রসারণ কিংবা বর্ণবিন্যাস পরিবর্তন হইয়াছে। দেহে রং প্রবেশ করাইয়া স্থায়ী অলঙ্কার বা চিত্র” (বাঙ্গালা শব্দকোষ)। আমাদের দেশে কম- বেশি সমস্ত সমাজে উলকির ব্যবহার রয়েছে। আমাদের গ্রামে ছেলেবেলায় দেখেছি, উলকি করার লোকেরা হঠাৎ কোথা থেকে এসে ছোট ছোট মেয়েদের হাতে পায়ে উলকি দিয়ে চলে যেত— আর পয়সা নিত, এখন আর সেই রকম দেখি না। তবে আদিবাসীদের জনপ্রিয় পরব পাটাবিধাতে দেখেছি মেলার প্রান্তে গাছের তলায় আদিবাসী মেয়েরা উলকি নিচ্ছে। উলকির ব্যবহার সারা পৃথিবীতেই ছিল। উলকি বা Tattooing সম্বন্ধে Encyclopaedia Britannica বলেছেন- Tattooing consists of puncturing the skin in the pattern desired and rubbing in colouring material so that the pattern is indelibly fixed. In New Zealand the Maoris brought Tattooing to a very high art, and the intricate pattern with which they adorned their faces were executed with exquisite workmanship and taste. .....In China, Borneo, India and other parts of the Far East tattooing is prevalent and thence has been introduced into Europe chiefly by sailors. Arms, legs, body and face are all considered suitable surfaces for decoration. Today tattooing saloons exist in London and Many of the bigger sea-ports.
এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় অতি সভ্য দেশগুলিতেও উলকি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তবে আমাদের দেশে আদিবাসী সমাজেই উলকির জনপ্রিয়তা বেশি। এর পেছনে কাজ করে আসছে প্রাচীনকাল থেকে একটা মনোভাব। বিশেষ করে কোল সমাজে (Austric) গোত্র নির্ধারক উলকির ব্যবহার ছিল। এখন তা শিথিল হয়ে গেছে।
সাঁওতালিতে উলকিকে বলে খোদা (খোদাই)। আর যারা খোদা করে দেয় সেই শিল্পীর নাম খোদনা (পুং), খুদনি (স্ত্রী)। স্বৰ্গতঃ বন্ধু অধ্যাপক ডাঃ ধীরেন্দ্র নাথ সাহা” ‘ঝাড়খণ্ডী লোকভাষায় গান’ পুস্তকে বেশ কয়েকটি সঙ্গীত প্রকাশ করেছিলেন যাতে উলকির উল্লেখ রয়েছে। যেমন একটি গান এইরকম—
সনাগড়া ফুলমনি জামশোল ফুদনি
তিরিবিরি ফুলমনি তরার কাঁদে
যবার টিপে ফুলমনি তবার কাঁদে
এত কিসে ফুলমনি আলাদী দেহ! (সাঁওতালী পাতাগীত)
অর্থাৎ— সোনাগাড়া গাঁয়ের মেয়ে ফুলমনি অর জামশোলের মেয়ে ফুদনি সরু সরু উলকি নিতে বসল। যতবার ফোঁড়ে, ফুলমনি ততবার কেঁদে কেঁদে ওঠে। ফুলমনি, তোমার কিসের এত সুকুমার শরীর।
বিখ্যাত অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস উলকির চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। মনে হয় মধ্যযুগে মেয়েদের উলকি পরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিশেষ উপায় ছিল। ঈশ্বর গুপ্তের উদ্ধৃতি আছে— 'সিন্দুরের বিন্দুসহ কপালেতে উলকি'। ইত্যাদি.....
এখন রাঢ় বাঙলার অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে উলকি ব্যবহারের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলা যেতে পারে— অষ্ট্রিক বা খেরওয়াল গোষ্ঠীর লোকেদের মনে উলকির ব্যবহারে একটি প্রথাগত মানসিকতা কাজ করছে। তা হল, খেরওয়াল গোষ্ঠীর মানুষের ধারণা—পৃথিবীতে আগমন সূত্রে তাঁরা সি বোঁগা বা সূর্য্য দেবতার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা নিজদিগকে সূর্যবংশের সন্তান বলেই মনে করেন। জমসিম বিনতিতে এই সত্য আভাসিত হয়েছে। সেই ট্রাডিশনকে রক্ষার জন্য খেরওয়ালরা শরীরে যে উলকি নেন তাতে সূর্যের প্রতীককেই সর্বাধিক মূল্য দিয়ে থাকেন। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ অঞ্চ লে এই প্রবণতা লক্ষিত হয়। বর্তমান লেখকের ধারণা যেহেতু উড়িষ্যাতে দ্রাবিড় গোষ্ঠির বিভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে সেই হেতু উলকির মাধ্যমে সিঞ বোঁগা বা সূর্য দেবতার প্রতীককে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর লোকেরা। The Santals পুস্তকের লেখক চারুলাল মুখোপাধ্যায় (1939) ক্ষেত্র গবেষণার পর এই তথ্য দিয়েছেন।
(অপর পক্ষে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষ উলকির ব্যবহার করে থাকেন শুধুমাত্র নান্দনিক উদ্দেশ্যেই। যে কোন কারণেই হোক আদিম যুগ থেকে আজ অবধি উলকির জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়নি।
0 Reviews