মধ্যপূর্ব ভারতের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রাম

মধ্যপূর্ব ভারতের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রাম

Size

Read more

 মধ্যপূর্ব ভারতের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রাম







১৯৬৫ সাল। আমি তখন মেদিনীপুর জেলার রামগড় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমি চলেছি ভাদ্র মাসে পায়ে হেঁটে বাইশ মাইল দূরে কোলাবনীর এঁদে অর্থাৎ ইন্দ্রপূজার মেলা দেখতে। আসল ইন্দ্ৰপূজা হয় ঝাড়গ্রাম মল্লরাজদের রাজবাড়ির সামনে। একটা বিশাল শালগাছ কেটে এনে পুজো দিয়ে খাড়া করে দাঁড় করানো হয়। ভাদ্র মাসের সেই সময় আদিবাসী অঞ্চ লের শস্যের ক্ষেতগুলোতে শাল গাছের পহা/চারা (off shoot) কিংবা ডালাই গাছের ডাল পুঁতে দেওয়া হয়। চাষীদের বিশ্বাস সেই সময় শস্যক্ষেতে ডাল পুঁতে দিলে শস্যও তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে। ভাদ্র মাসের ভরা কংসাবতী নদী পেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা যখন ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকতে যাচ্ছি তখন আমার উপর ক্লাসের একজন দাদা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন— ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকলে আমি যেন চুপ করে থাকি। কেন না আমি তখনো বাংলা ভাষা ঠিকমত রপ্ত করতে পারিনি। সর্বদাই আমি নিজের মাতৃভাষা সাঁওতালীতেই কথা বলে থাকি। আমি ছিলাম পরব দেখা দলের সর্ব কনিষ্ঠ কিশোর। যতক্ষণ ঝাড়গ্রাম শহরের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি ততক্ষণ আমি কি বাংলা কি সাঁওতালীতে একটা কথাও বলিনি। ইস্কুলের মাস্টার মশাইরাও ঠারে কথা বলতে বারণ করতেন। ঝাড়গ্রাম শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকতেই লোকবনী পরবের রোগড়া টামাকের বোল—টাঙ্গুন টাঙ্গুন টাঙ্গুনটাক্, টাটাক্ টাঙ্গুন টাঙ্গুনটাক্—শুনে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আঠারো মাইল পথ হাঁটার ক্লান্তি ভুলে গেলাম। রোগড়া টামাকের তালে তালে পা ফেলতে আরম্ভ করলাম। আমি তখন বন্ধনহীন প্রকৃতির কোলে খেরোয়ালি পৃথিবীতে। সেদিনের কিশোর মনের নির্বাকায়ন ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের কী যে জ্বালা—সেটা আজও মনকে পীড়া দেয় ৷ নিজের অজান্তে কখন পৌঁছে গেলাম পরব টাঁইড়ো। রাত হয়ে গেছে। পরব ট্যাড়ে ঘুরছি। এক জায়গায় দেখলাম— নব যৌবনা সারজম পহা (শালচারা) দুটো আইবুড়ো সাঁওতাল মেয়ে। খোঁপা ভরা বিনি সুতোর কুড়চি ফুলে ফুলে গাঁথা মালা, গলা ধরাধরি

করে আপন মনে গেয়ে চলেছে—

নতে নতে সরাই কল্লা

নতে নতে পাওরা বুরু গো,

ইনী তালা, ইনী তালা দেকো কড়া

হড়তে রড়ায় গো ।

ওনাতেগে দিসম দরে বয়হা

ডামাডোল এনারে

খেরোয়াল জাতি সমাজ

মালট এনারে।

—অর্থাৎ একদিকে, সেরাইকেল্লা, অন্যদিকে পায়রা পাহাড়। তারই মধ্যিখানে দিকু ছোঁড়া সাঁওতালীতে কথা বলছে— এবং তারই জন্য দেশটা উচ্ছন্নে গেল খেরোয়াল জাত সমাজ নষ্ট হয়ে গেল। ঝাড়খণ্ড লোক ভাষার চরিত্র প্রসঙ্গে ধীবেন্দ্র সাহা বলেছেন—সাঁওতালী পাতা গীতগুলির বিষয়বস্তুতে আধ্যাত্মিকতা নেই, সবই জীবন ঘনিষ্ঠ রচনা। প্রত্যেকটিই দৃষ্ট অভিজ্ঞতায় প্রত্যক্ষ নির্ভর। নায়ক বা নায়িকারা পরিচিত গ্রাম ভূগোলের জানা-মানার অধিবাসী। প্রত্যেকের বিশিষ্ট অঙ্গভঙ্গি ও পদক্ষেপ সরজমিনের জরিপে জানা। এদের মন মেজাজের অবিকল ছবি যাদের মুখস্থ তারাই এ গানের রচয়িত্রী।' সাঁওতাল লোক সংগীত ও লোকজীবন আলোচনা প্রসঙ্গে মহম্মদ আব্দুল জলিল বলেন- সাঁওতাল সমাজ জীবনের চিরস্থায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন হল তাদের লোক সংগীত। লোকসঙ্গীত হচ্ছে সুর সংযোজিত হৃদয়বাণী। সংগীতে সুরধ্বনি মানুষের প্রয়াস সাধ্য কন্ঠধ্বনি হলেও স্বতঃস্ফুর্ত হৃদয়বেদ্য ধ্বনিময় বাক-প্রকাশ ও সংগীত। আর এ কারণেই বলা যায়, অনাদিকালের মানুষের সাংস্কৃতি চেতনার অন্যতম ধারা সংগীতের বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত বাক্ প্রকাশকে কেন্দ্র করেই। সাঁওতাল সমাজে, সাঁওতাল লোক জীবনে, সংগীতের বিকাশ আর বিস্তারের উৎস সন্ধান করলে এই স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশেরই পরিচয় মেলে। স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে থাকে অকৃত্রিমতা, আর অকৃত্রিমতাই বহন করে শাশ্বতের উপাদান। বাংলাদেশের সাঁওতাল লোক সংগীতগুলো তাদের জীবনবেদ, তাদের অখণ্ড সমাজের এক সমুজ্জ্বল দিক বিশেষ।'

সাঁওতালী ভাষা অস্ট্রিয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। Sir George Grierson তাঁর Lingustic Survey of India (Vol-IV) পুস্তকে মুণ্ডারী, সাঁওতালী, হো, কড়া, মাহালী, ভূমিজ, তুড়ি, আসুরি প্রভৃতি ভাষাকে মুণ্ডা ভাষার খেরোয়ালি শাখা বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৬৮ সালে বীরভূমের সাঁওতালদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে W. W. Hunter -The Santal owes nothing of his Skill in husbandry to the Aryans, he Has crops of his own, implementation of his own, own system of cultivation and an abundant vocabulary of rural life not one word of which he has borrowed from his superior race who has ousted him from his heritage in the valley. (Annals of Rural Bengal pp-115). 


১৯২৫ সাল থেকে Rev. P.O. Bodding ত্রিশ হাজারের অধিক শব্দ নিয়ে পাঁচটি খণ্ডে A Santal Dictionary সংকলন শুরু করেন। চৌদ্দ খণ্ডে Hoff Mann সংকলন করেন বিশালাকায় Encyclopaedia Mundarica. ভারতে কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটায় মধ্য পূর্ব ভারতের আদিবাসীরা। বাঁকুড়া জেলার ছাতনা থানায় অবস্থিত শুশুনিয়া বুরু। শুশুন মুণ্ডারী শব্দ অর্থ নৃত্য, ইয়া প্রত্যয় বুরু-পাহাড়। অর্থাৎ নৃত্যরত পাহাড়। শুশুনিয়া পাহাড়ের মারাঙ ধিরি দান্দহের অর্থাৎ বড় পাথরের গুহাকে পুরাতাত্ত্বিকরা Oldest habitat of mankind বলে দাবি করেন। পুরাতাত্ত্বিক ডঃ রেবা রায় তাঁর Ancient Settlement patterns of Eastern India -Susunia thickly wooded during the period had an important concentration of temporary camps of the palaeolithic people who throughout this long period continued to wander about in this area taking vesorts to several open camp sides. পি. সি. দাশগুপ্ত বলেন- one of the largest factory sites of early stone Age in Eastern India (LAR 1965-66 pp. 55-57).

আমার ভাবতে কষ্ট হয় যে এত শব্দ ভাণ্ডারের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কী কারণে খেরোয়ালি জাতিসত্তার মানুষের ভাষাকে ইঙ্গিত বা ঠার' বলে চালানো হল। খেরোয়ালি লোক সংগীতে তাদের পূর্ব পুরুষদের চায়, চাম্পা, চিরুনাগড় দূর্গের কথা বিধৃত আছে—

জীত মানওয়া হো জাঁতি খেরোয়াল, লিলিবিছি তাবোন আবোন দিসম। হিহিড়ি পিপিড়ি, চার চাম্পা গাড়। ধিরি দালান চূড়া নাবোনাক্‌গে (সংগ্রহ-দিলীপ সরেন)

অর্থাৎ— খেরোয়াল জাতির মানুষ আমরা বর্ণময় আমাদের দেশ, হিহিড়ি পিপিড়ি, চায় চাম্পার প্রস্তর নির্মিত চূড়া আমাদেরই সৃষ্টি।

মুগ্ধা কোন জাতিগোষ্ঠীর নাম নয়। নৃতাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার ঘেরাটোপে বহিরাগতদের দেওয়া নাম মুণ্ডা। সাঁওতালদের মতো মুণ্ডারা নিজেদের বলেন হড় (অ) জাতীয় নাম বজায় ছিল। 'চামপা পর্যন্ত তাদের জাতীয় নাম বজায় ছিল 'চামপা' ধাবিচ্ আলে আর মুডাকো, বিরহড়কো কুঁড়বি এমানতেনকো দ খেরোয়াল মেনতেলে বিকাউকান তাহেঁকানা । (মারে হাপড়াম কো রেয়াক্ কাথা পৃ-১২)। The Munda and their country বইয়েতে শরৎচন্দ্র রায় বলেছেন— রোহতাস গড় পর্যন্ত মুণ্ডা জাতির মানুষেরা একই গোষ্ঠীভূক্ত ছিল। Dr. B. P. Keshri এর অভিমত অনুযায়ী—The Spirit of national unity in Jharkhand region began to disintegrate with the commencement of the permanent settlement of 1793 (AD). With the passage of time the crack widened, although internal endeavours the cement it were seen from time to time. With the passage of brute economic exploitation of the British imperialism distributed the composite Jharkhand belt among tour different states to wipe out the existence from the map. This cruel conspiracy (Problem and prospects of Jharkhand Languages. Fourth world dynamic, Jharkhand pp.138)

আমার ভাবতে কষ্ট হয়—মধ্যপূর্ব ভারতে খেরোয়ালি জাতিসত্তার মানুষ সারা ভারতে কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটাল। ভারতবাসীকে কাপড় পরাতে শেখাল তারা আজ অসভ্য, জংলী, বনুয়া, বনবাসী হয়ে রইল। অন্যদিকে যারা ঘোড়ার পিঠে লুণ্ঠন করতে এদেশে এল, যাদের বৃত্তি চৌর্য্যবৃত্তি তারা আজ সভ্য আৰ্য (noble born) জাতি।

আমরা খোলা মন নিয়ে পিছন ফিরে অতীতের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা কখনো করিনি। আরণ্যক স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজা দোবরু পান্নার পূর্ব পুরুষের সমাধিস্থলের বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেরেছিলেন— সে অপরাহের ছায়ায় পাহাড়ের উপর সে বিশাল তরুতলে দাঁড়াইয়া যেন সর্বব্যাপী শাশ্বতকালের পিছন দিকে বহুদূর অন্য এক অভিজ্ঞতার জগৎ দেখিতে পাইলাম পৌরাণিক ও বৈদিক যুগও যার তুলনায় বর্তমানের পর্যায়ে পড়িয়া যায়।

দেখিতে পাইলাম যাযাবর আর্যগণ উত্তর-পশ্চিম গিরিবর্ত অতিক্রম করিয়া স্রোতের মত অনার্য আদিম জাতি শাসিত প্রাচীন ভারতে প্রবেশ করিতেছেন। ভারতে পরবর্তী যা কিছু ইতিহাস—এই আর্য সভ্যতার ইতিহাস—বিজিত অনার্য জাতিদের ইতিহাস কোথাও লেখা নেই—কিংবা সে লেখা আছে এইসব গুপ্ত গিরিগুহায়। অরণ্যানীর অন্ধকারে “চূর্ণায়মান” অস্থি কঙ্কালের রেখায়। সে লিপির পাঠোদ্ধার করতে বিজয়ী আর্যজাতি কখনও “ব্যস্ত হয় নাই”। আজও বিজিত হতভাগ্য আদিম জাতিগণ তেমনিই অবহেলিত, অবমানিত, উপেক্ষিত। সভ্যতা দীপ আর্যগণ তাহাদের দিকে কখনও ফিরিয়া চাহে নাই, তাহাদের সভ্যতা বুঝিবার চেষ্টা করে নাই, আজও করে না। (আরণ্যক পৃঃ-১০১)

১৭৬৫ সালে দ্বিতীয় বাদশা শাহ্ আলম ছোটনাগপুরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধিকার মেনে নেয়। ফলে ১৭৬৭ সাল থেকে ইংরেজরা অধিক সংখ্যায় ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করতে থাকে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জঙ্গল হাসিল জমিকে বাবুদের স্বার্থে পণ্য করা হয়। আদিবাসী এবং দেশীয় জমিদারদের উৎখাত করে নব্য মধ্যবিত্ত শারদীয়া আদিবাসী জগৎ প্রবন্ধ সমগ্র-৩ 


বর্ণবাদী ভোগবিলাসী জমিদারদের বসানো শুরু হয়। পাইকান স্বত্ত্ব বিলোপ করা হয় যার ফলস্বরূপ সংঘঠিত হয় ভূমিজ বা চুয়াড় বিদ্রোহ। ইংরেজ ঐতিহাসিক Mill বলেন— When the powers of the political agents were curtailed and the troops of the frontier reduced, the barbarous tribes relapsed into indulgence of their former propensities লাগাতার আন্দোলন চলে ১৮৩২-৩৩ সালের গঙ্গা নারায়ণের হাঙ্গামা পর্যন্ত। জগদীশ চন্দ্র ঝা কোল বিদ্রোহকে — "A crude form of protest against the hinduisation and alienation of the tribe Rajas and Zamindars নামে অভিহিত করেছিলেন।

‘স্বাধীন ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পের উপর নির্ভরশীল হতে না পেরে ইংরেজ সৃষ্ট জমিদারের উপর মূলত নির্ভরশীল হতে থাকার ফলে মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের এই দুর্বলতাই সৃষ্টি করেছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ - বদরুদ্দীন উমর)।

১৭৭৯ সালে আগস্ট ক্লিভল্যাণ্ড ভাগলপুরের কালেক্টর হয়ে আসার পর তিনি সাঁওতালদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। মাল পাহাড়িয়াদের বখশিসের লোভ দেখিয়ে সাঁওতালদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দু'টো গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ নীতি চালু করেও কোনরকম ফায়দা তুলতে পারেননি। ১৭৮৪ সালে তিলকা মাঝির (মুরমু) নেতৃত্বে খণ্ডযুদ্ধে স্বয়ং ক্লিভল্যাণ্ডকেই তিলকার বাঁটুলে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। ১৮৩১-৩২ সালে সিংভূমের কোল বিদ্রোহে সুরগা ও সিং-রাই সমস্ত বহিরাগতদের নিজেদের এলাকা থেকে দূর করতে চেয়েছিলেন। ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত মুণ্ডা শাখার একটি গোষ্ঠী হো-সম্প্রদায় সিংভূম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সরাক এবং ভুঁইয়াদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালিয়েছিল। পোরাহাট, সেরাইকেল্লা ও ময়ূরভঞ্জের জমিদাররাও হো-দের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় জমিদারদের সহযোগিতায় কোলহান দখল করার চেষ্টা করে। ১৮৩৭ সলে লাড়কা কোলেরা ব্রিটিশ সরকারের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং ওই বছরেই লাড়কা কোলেদের ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাকে আলাদাভাবে শাসন করার জন্য Kolhan Government Estate গঠন করা হয়।

ভাগলপুর, বীরভূম আর মুর্শিদাবাদের ১৩৬৬.০১ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ১৮৩২-৩৩ সালে গঠিত হয় দামিন-ই-কোহ্ অর্থাৎ পাহাড়ের প্রান্তদেশ। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে কটক, ধলভূম, বরাভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বীরভূম থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজনদের নিয়ে গিয়ে শ্বাপদ-সংকুল অঞ্চ লের জঙ্গল হাসিল করানো হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাহাড়িয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাঁওতালরা জঙ্গল হাসিল করে সোনার ফসল ফলিয়েছিল। সুদখোর মহাজন, দেশীয় জমিদার, নীলকর এবং ইংরেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৫-৫৬ সালে সিদো, কানহু, চাঁদ এবং ভায়রোর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল ভারতের প্রথম গণ আন্দোলন ‘সাঁওতাল হুল’। ‘চেদাক’ দরে সিদো হো মায়ামতে দম নুমেন? ‘চেদাক' দরে কানহু হো, হুল হুলেম মেমেন? জীত ভীইকো লীগিৎ মায়ামতে দম নুমেন, বেপারিয়া কোম্বড়ো হায়রে দিসম দকো হুহি।' W. A. Archer সাহেবের অনুবাদ মত — Sido, why are you bathed in blood? Kanu why do you cry hul hul? Follower people we have bathed in blood. For the traders thieves. Have robbed us of our land. ভারতে সমগ্র সাঁওতাল এলাকায় আওয়াজ উঠেছিল—ধান জুড়িহে, ঢোল বাজেহে, ঢাক বাজে হে, সিদো কানহু চাঁদ ভায়রো হুলে হু-লে, হুলে হু-লে, হুলে হু-লে, নুপুচ্ নুপুচ্ দেলাঙ জা দেলাঙ জা ।

অর্থাৎ—শুনহে ‘ধানজুড়িবাসী (দেশবাসী) বাজছে ঢোল, বাজছে ঢাক, সিদো কানহু চাঁদ, ডায়রো করেছে বিদ্রোহ, চল শীঘ্রি করে চল।' (দ্রঃ সি. এইচ. কুমার— সান্তাল পারগানআর পাহাড়িয়া কেওয়াক্ ইতিহাস অনুবাদ-দিলীপ সরেন)।

সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সুপ্রকাশ রায় বলেন— ১৮৫৫-৫৭ খৃষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে অতুলনীয়। কেবলমাত্র ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সহিত ইহার আংশিকভাবে তুলনা করা চলে। সে প্রকারের শাসন ও শোষণ উৎপীড়ন হইতে পরাধীন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সৃষ্টি হয়। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের সাঁওতাল উপজাতি বিদ্রোহ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই প্রকারের শাসন ও শোষণ উৎপীড়ন অবশ্যম্ভাবী। এই উভয় সংগ্রামই আরম্ভ হইয়াছিল ইংরেজ শাসনের কবল হইতে মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ধবনি লইয়া। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম)। আবার সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন—বিদ্রোহী সাঁওতালদের অসমাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিদ্রোহী ভারতের জনগণ নিজেদের সংগ্রাম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে আর সাঁওতালেরা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চির উজ্জ্বল রক্তের স্বাক্ষর রাখিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। (মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কৃষক-পৃঃ-৫২)।

আমার মনে হয় সাঁওতালরা নিজেরা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে কথা অনেকাংশে ঠিক নয়। কেন না সংবাদ প্রভাকরে সাঁওতাল বিদ্রোহকে বর্বরদের বিদ্রোহ এবং তারা মহান 

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শান্তি ভঙ্গ করিতেছিল বলিয়া মন্তব্য করা হয়েছিল। আসলে 'জমিদারী প্রথা থেকে যে আট কোটির মতো টাকা বছরে প্রজাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় এবং তার দশ ভাগের নয় ভাগই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে বণ্টন করা হয়। কাজেই জমিদারী প্রথা উঠে গেলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক জীবনে বিশেষ ঝুঁকি লাগবে। কাজেই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে অর্থনৈতিক আত্মহত্যা করতে পারে না।' (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক উমর পৃঃ-৪১)।

‘সিদো কানহু দ্বারা সংগঠিত ‘হুল’ ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আত্ম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আদিবাসী সংগ্রামগুলিকে মূলতঃ অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আন্দোলনই বলা চলে। প্রত্যেকটি সংগ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস রয়েছে। এইসব আন্দোলনগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল উৎপীড়ক বিদেশীদের হাত থেকে দেশকে জাতিকে মুক্ত রেখে নিজেদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতবাহী স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করে শ্রেণীহীন, শোষণহীন সাম্রাজ্য স্থাপন করা।' (পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী আন্দোলন—অমল কুমার দাস পৃঃ-২৭)।

১৮৪৫ সাল থেকে ছোটনাগপুরে মিশনারীদের প্রবেশ ঘটে। অনেক আদিবাসী খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়। জমিদার এবং ঠিকাদারদের থেকে বাঁচবার জন্য, স্বর্গের বাণী শোনবার জন্য নয়। 'The tribals of Chotanagpur were attracted help towards them only on their (missionaries) assured help to fight alien thikdars and Jagirdars. The tribals had little to do with the spiritual tenets of the christianity or the kingdom of heaven. (Life and Time of Birsa Bhagwan. - S.P. Sinha, p. - 36) 1

১৮৭১ সাল থেকে ১৮৭৯ পর্যন্ত ভগীরথ মাঝি সাঁওতালদের মধ্যে ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনের নাম ছিল খেরোয়ালী আন্দোলন। খেরওয়াল আন্দোলনই প্রথম আন্দোলন যেখানে ধর্ম এবং রাজনীতির যোগের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়। প্রায় ’৬৪ অব্দে মাদরা মুণ্ডার পালিত পুত্র ফণী মুকুট রায়কে মুণ্ডারা প্রথমে মহারাজা নির্বাচিত করেন। মুণ্ডারা মহারাজার নিকট মানকিদের মারফৎ ইচ্ছামত কিছু নজরানা পাঠাত। রাজাও সন্তুষ্ট থাকতেন। কালক্রমে নির্বাচিত রাজার নিকট সকল মুণ্ডা, পাহান, মানকিরা বশ্যতা স্বীকার করেন। ধীরে ধীরে রাজা নির্বাচিত হওয়ার বদলে বংশগত রূপ নিল। রাজারা আড়ম্বরপূর্ণ জীবন আরম্ভ করলেন। অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দের জন্য খাজনা প্রথার প্রবর্তন হলো। বাইরের রাজারা ছোটনাগপুর রাজার কাছে দামী দামী ঘোড়া, শাল ইত্যাদি ভেট পাঠাতে আরম্ভ করল। রাজপুত বংশের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হলো। রাজকার্য পরিচালনার জন্য বিহার ও মধ্যপ্রদেশ থেকে লোক আনানো শুরু হলো। পাহানদের বদলে ব্রাহ্মণদের দিয়ে মুণ্ডাদের প্রধান দেবতা সিঞ বোঙগার পূজা অর্চনা করানো হলো। ভিনদেশী কর্মচারীরা জায়গীরদার, ঠিকাদার এবং মহাজনে পরিণত হলো। জায়গীরদারেরা স্থানীয় রায়তদের উপর অধিক হারে কর চাপাতে আরম্ভ করল। এদের অত্যাচারে মুণ্ডা সমাজ-জীবনে নেমে এল গভীর দুর্দশা। যারা নির্বাচিত প্রথায় রাজা নির্বাচন করেছিল তারই বীজ তাদেরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মুণ্ডারা এই আত্মঘাতী প্রথাকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বিপদ বুঝে মহারাজা সৈন্যদল বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হলেন। ভিনদেশী ছত্রীরা, বড়হিক এবং রোতিয়া জাতিভুক্ত লোকেদের সৈন্য বাহিনীতে নিয়োগ করা হলো। মুণ্ডাদের পরম্পরাগত জমি এবং জংগল সংক্রান্ত নীতি ওলট-পালট হতে আরম্ভ হলো। ১৫৮০ সালে মহারাজ মান সিং ছোটনাগপুর আক্রমণ করেন। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় রাজধানী রাঁচী থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম ডুইসা নামক স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭৬৫ সালে বাদশা শাহ আলম(২) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অধিকার মেনে নেয়। ফলে ১৭৬৭ সাল থেকে ইংরেজরা অধিক সংখ্যায় ঝাড়খণ্ড এলাকায় প্রবেশ করতে থাকে। এলাকার সামন্ত রাজাদের উপর বর্ধিত হারে রাজস্ব আদায়ের চাপ দিতে থাকে। ঝাড়খণ্ডীদের উপর চলে শোষণ ও অত্যাচার।

শাল, সেগুন, মহুয়ার জঙ্গলে রাজমহল থেকে ডোমবারির গুহা কন্দরে বার বার ধ্বনিত হয়েছে গুলির আওয়াজ। কালের আবর্তে মহা বিদ্রোহের রূপ নিতে পারেনি ঠিকই তবে লড়াই থেমে থাকেনি। সেই ১৭৯৮-১৯ সালের ভূমিজ বা চুয়াড় বিদ্রোহ দিয়ে শুরু। ময়ূরাক্ষী সুবর্ণরেখাতে কত রক্ত বয়ে গেছে। ঝাড়খণ্ডী মানুষের চাপ চাপ রক্ত ঝাড়খণ্ডের মাটির নীচে সোনা হয়ে ফলেছে। প্রকৃতির সন্তান ঝাড়খণ্ডী মানুষ। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয় সহজ সরল এবং মুক্ত হতে। মুক্তির স্বাদ এদের শিরা ও উপশিরায়— ‘The Munda of Chotanagpur under the leadership of Birsa were prepared to wage a war against Her Majesty's Government Tilak had not yet given the famous cry, Swarajya is our birthright to the nationalist India, Sir Surendranath Banerjee had not come before the thinking public with inspiring campaign for the boycott of foreign goods and Mahatma Gandhi had not yet seen on the political scene with his weapon of non-violent, non-co-operation which subsequently developed into the Quit India movement. (Life and times of Birsa Bhagwan, pp. -18) 


পক্ষান্তরে, বিরসা শ্লোগান তুলেছিল—সোনলিকা দিসুম তাবু (সোনার মত আমাদের দেশ) মহারাণি রাজ তুনডুজানা ওরো আধুয়াঃ এতেজানা (মহারাণির শেষ এবং আমাদের রাজত্ব শুরু)। বিরসার ধরম মুণ্ডা জীবন দর্শনের আধারে হিন্দু এবং খৃষ্টীয় ধর্মের সংমিশ্রণ। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক সচ্চিদানন্দ বিরসা মুণ্ডার উলগুলান প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—Birsa movement was an embodiment of socio-economic and religious unrest among the Mundas. Buffeted by the waves of repression and oppression and torn by despair, the Munda saw in Birsa a prophet and a saviour, Birsa's religion is a combination of Munda belief, Hinduism and Christianity. The movement had such a tremendous impact that the foundation of British rule in Chotanagpur was shaker for some time.

পাঁচশ বছর আগে মহাপ্রভু ঝারিখণ্ডের উপর দিয়ে নীলাচলে যাওয়ার সময় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। ঝাড়খণ্ডের বহু আদিবাসী বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিরসা মুণ্ডাও বৈষ্ণব গুরু আনন্দ পাঁড়ের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের যাত্রা ওঁরাও-এর টানা ভকত আন্দোলনের মধ্যে ওঁরাও ধর্ম শুদ্ধি করণের রূপ দেখতে পাই। ১৯২১, ১৯৩০, ১৯৪১ এবং ১৯৪২ সালের মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে বহু আদিবাসী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩০ সালে মানভূমে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হতে গিয়ে গোকুল মাহাতো, মোহন মাহাতো, গণেশ মাহাতো এবং শীতল মাহাতোকে ব্রিটিশ সরকারের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। ফলে ১৯৩১ সাল থেকে সাঁওতাল, মাহাতো ইত্যাদি আদিবাসী জাতিদের তপশিলী তালিকা থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল। ঊনিশ শতকে দ্বিতীয় দশকের শেষের দিকে এবং তৃতীয় দশকের শুরুর দিকে মাহাতো, ভূমিজ, কোচ, রাজবংশী ও সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষকে ক্ষত্রিয় করণের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ক্ষত্রিয় করণের প্রচেষ্টা অনেকাংশে সার্থক হয়। মাহাতো, ভূমিজ, কোচ, রাজবংশী ও সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসীরা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। ১৩৩৪ সালের ২২ এবং ২৩শে চৈত্র চেমেংজুড়িতে ‘সাঁওতাল জাতীয় সমাজ সংস্কার বিষয়ক দেশ বিষয়গণের বিরাট শোভার’ এগ্রিমেন্ট-এ কালিকাপুর দামপাড়া, সিলদা, বোহড়াগুড়া, কুচংপীড়, পড়িহাটি, পাওড়া, আশানবনী, ময়ূরভঞ্জ, ডুমরাপী, হলুদপুকুর, পড়াহাট ষ্টেট প্রভৃতি তরফের মাঝি পারগাণারা সিদ্ধান্ত নেন যে—'সাঁওতালরা জাতিতে ক্ষত্রিয় লিখিবেন এবং পদবী রায় লিখিবেন। বিবাহ পাতা পরবে নাচগান করিবেন না।' ১৯৩১ সালের কুর্মি ক্ষত্রিয় মহাসভাতে মাহাতোরা ক্ষত্রিয় মর্যাদার দাবি করেন। ১৯২৭ সালে মালদহে জিতু সাঁওতাল (জিতু হেমব্রম) দিনাজপুরের উকিল কাশীশ্বর চক্রবর্তীর প্ররোচনায় হিন্দুভাবাপন্ন ‘সত্যম্ শিবম্' ধর্ম প্রচার করেন। ধর্মীয়রূপ রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে মোড় নেয়। জিতু সাঁওতাল পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ দখল করতে চাইলে ১৯৩২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাঁকে মসজিদে গুলি করে মারা হয়।

১৯১৫ সালে গঠিত হয় ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ। ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের কাছে প্রথম আলাদা রাজ্যের দাবি জানায়। ১৯৩৮ সালে জয়পাল সিঞের নেতৃত্বে গঠিত হয় আদিবাসী মহাসভা। জয়পাল সিঞ আদিবাসী সমাজে নতুন আশা, নতুন উদ্দীপনা এবং নতুন আকাঙ্খার সঞ্চার করেন। সাঁওতাল সমাজে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে রামদাস টুডু রেসকা, সাধু রামচাঁদ মুরমু, পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু, পাউল জুঝার সরেন, সুন্দর মোহন হেমব্রম, শুনারাম সরেন প্রভৃতি মনীষিরা সাঁওতাল সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস নেন। ১৮৯৫ সাল নাগাদ রামদাস টুডু রেসকা “খেরোয়াল বংশা ধরম পুঁথি” রচনা করেন। সাধু রামচাঁদ চুয়ী গান রচনা করেন- দেবোন তেঙগোম আদিবাসী বীর দ, দেবোন তেঙগোলং আদিবাসী বিরসা বীর।” (এস আদিবাসী বীর, আমরা রুখে দাঁড়াই)। তিনি আদিবাসী ঐক্যের গান লেখেন—'দেস দিসম কুড়ি কড়া/আদিবাসী আরো ঝতগে পেড়া। জাহাঁতিস জাহাঁকাল/সীঙগিঞ হর জ্ঞাপাম, রীসকী রপড়াবো দুকবো রপাম। (দেশে বিদেশের আদিবাসী নারী-পুরুষ, আমরা সবাই আত্মীয়, যদি কোনদিন কোন কালে দূর ডহরে দেখা হয়, সুখ-দুঃখের কথা দেওয়া নেওয়া করব। আমাদের মনের জ্বালা জুড়াব)। তাঁর আর একটি গান—কামার বাঁদী নবীন দিসম রফা তেঙ্গোনায় জামিন/খেরওয়াল দেস ভাই হিজুক’পৈ দেলা/উদ্‌গাবো জাতি তরাও সেরওয়া রেলা। (কামারবাঁদী গ্রামের নবীন জাতির উন্নতিকল্পে সমর্পিত প্রাণ, খেরোয়াল ভাই সব সমবেত হও, এসো জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখাই)। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য— ১৯৩৫ সালে বামনির তরফ সরদার দীনবন্ধু সিং তরফের ৫৯টি গ্রামবাসীদের নিয়ে চেলিয়ামা গ্রামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন—মানভূম ভূমিজ ক্ষত্রিয় সমিতি। ওই বছরেই তিনি চেলিয়ামা গ্রামে সম্মেলন ডাকেন। প্রায় দু'হাজার ভূমিজ সম্মেলনে হাজির হন। একজন তেওয়ারী আর একজন পাণ্ডা ব্রাহ্মণকে উড়িষ্যা থেকে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। সম্মেলনের প্রধান বক্তা দীনবন্ধু সিং বলেন—“আমাদের পাশাপাশি হিন্দুরা বলতে আরম্ভ করেছে যে ভূমিজরা ধীরে ধীরে আদিবাসী হয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের উপহাস করছে এবং আমরা নাকি হিন্দুশাস্ত্র লঙ্ঘন করছি। আমাদের হাঁড়িয়া মদ ছাড়তে হবে এবং হিন্দু ধর্ম আচরণ করতে হবে। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে 'ভূমিজরা গরু দিয়ে লাঙ্গল টানাবে না, হাঁড়িয়া মদ ছোঁবে না, মুরগী খাবে না, ভালবেসে বিয়ে বা ভুলাভুলি করবে না, সারহুল 

পরবে ধরাধরি করে নাচবে না, ব্রাহ্মণ বা বৈষ্ণব গুরুদের দিয়ে বিশেষ মন্ত্র পড়াবে এবং শ্রাদ্ধশান্তি করবে। ধর্মশাস্ত্র রামায়ণ, মহাভারত পড়ার জন্য লিখতে পড়তে শিখবে। বাংলা ১৩৬০ সালের ২৬শে এবং ২৭শে চৈত্র চাণ্ডিল থানার কেতুঙ্গা হাই স্কুল প্রাঙ্গণে ভূমিজ ক্ষত্রিয় সমাজের দুদিনের সভা বসে। সভায় জুগিলঙের ২৪ বছরের _যুবক কিশোরী মোহন সিংকে (মেট্রিক অকৃতকার্য) সভাপতি এবং মধুপুরের (ভাঙ্গাট) বাহাদুর সিংকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন বিহারের প্রচারমন্ত্রী অতুল সিং ভূঁইয়া (সরদার)

(1) This meeting expresses its deep regret at the labelling of the Bhumij as a 'wild tribe' in the voters list. This meeting draws the attention of the State and Union Goverments that the Bhumij should be excluded from list of 'wild tribes' and since it is in all respect clean Hindu Caste it so regarded by the Govenment also. This community observes in fullness all the prescribed rituals of the Hindu Castes. May be

(2) Steps will be taken for the spread of education; and a committee is to be fromed which would raise funds from our caste brothers and arrange for the spread of education.

(3) The money will be deposited with the secretary of the committee and it will be spent for education and social welfare.

(4) An association of Bhumij youth is to be formed soon.

(5) An Association is to be formed named Manbhum Bhumij Kshatriya Samaj. The association will be dedicated to the improvement of our community in all spheres of life.

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ বিশেষ করে ‘আঠাশ্যে' এবং ‘নগদি' গোষ্ঠীর মানুষেরা মূলতঃ জাতে ওঠার তাগিদে এবং সামন্ত্রতান্ত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ত্যাগ করে বাংলা এবং হিন্দী বুলি রপ্ত করতে আরম্ভ করে। স্বাধীনোত্তর ভারতে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক পট পরিবর্তন _তদোপরি ভারত সরকারের আদিবাসী কল্যাণ নীতির ফলে ভূমিজ জন-মানসে অনেকটা পরিবর্তন দেখা দেয়। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ড. সুরজিৎ সিংহ দীর্ঘদিন ভূমিজ সমাজের উপর গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন। তার মতে, “When some officials of the State Government personally seem to have played up to their aspiration to be recognized as Kshatriyas, with a little reluctance, the leaders sided with the protagonists of the Hindi Language as against the Bengali upper castes, whereas for generations the Bhumij had been speaking Bengali in this area. This perhaps demonstrates that their hankering for recognition as a high Hindu caste is deeper than their affiliation with neighbours on the basis of language alone. On account of this new political orientation it appears that the Bhumij Kshatriya organisation partially lost its attention upon ritual purification and social upgrading. They became more concerned about secular gains from the Government. (B.D.A Vol. VIII, July 1959).

সিলদা পরগণার কামারবাঁদি গ্রামের নবীন সরেন সেই সময় ওই অঞ্চ লে আদিবাসী মহাসভার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সাঁওতাল গাঁওতার পক্ষ থেকে সাঁওতাল জাতির আত্মপরিচয়ের দাবিতে কুঠার চিহ্নে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। চল্লিশের দশকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু “খেরোয়াল বীর”, “বিদু চাঁদান”, “দাড়েগে ধন” প্রভৃতি নাটক লিখে প্রতিষ্ঠিত সাঁওতাল সমাজের মধ্যে নবজাগরণ এনে ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরা স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগষ্ট রাতে আঁধারে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের তিনমাস ষোলদিনের মাথায় অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারী স্বাধীন ভারতে নিরস্ত্র নিরপরাধ নিরন্ন আদিবাসী উপহার পেল ৩৫ রাউন্ড মেসিন গানের গুলি। গুলি চালাল উড়িষ্যা মিলিটারী পুলিস। গুলির আদেশ দিয়েছিলেন বালেশ্বরের মাননীয় জেলাশাসক মোহান্তি সাহেব। উদ্দেশ্য—আদিবাসীদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি। দৃষ্টান্ত মূলক সন্ত্রাস। খরসোঁয়ায় ১লা জানুয়ারী আদিবাসী মহাসভার সম্মেলন ছিল। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন—জয়পাল সিঞ, লাখো বদরা, কানু রায়, হানস্ বি. বি. সোয়ে এবং মহিলা কমিটির পক্ষে ছিলেন দয়াময়ী গোপ, পুরা সীতারাম। বিকেল ২-২০ মিনিটে সভা শুরু হয় খরসোয়ার রাজবাড়ির সামনের মাঠে। বিকেল ৫-৩০ মিনিটে সভা শেষ হলে নেতারা চলে যাওয়ার পর মিছিল করে আদিবাসী জনতা রেল স্টেশনে ফিরছিল। আগে থেকে ডুংরির উপরে উড়িষ্যা পুলিসের মিলিটারী পুলিসের মেসিনগান তাক করাই ছিল। পেছন দিক থেকে গুলি চালানো হলো। ৫৫০- ৬০০ আদিবাসী ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। আহতদের সংখ্যা ১৫০০ মতো। 


জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটে ব্রিটিশ ভারতে, খরসোয়ার গুলিকাণ্ড ঘটে স্বাধীন ভারতে। গুলিকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত আজও হয়নি। (বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শীর—মার্টিন সোয়ে, বয়স-৮৬, রোড নং-৬, গিতিল পিড়ি, মানগো, জামসেদপুর-৮৩১০১২)। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বাঁকুড়া ফুলকুশমা হাতকাটা গ্রামের ক্ষেত্রমোহন সরেনের জ্যাঠামশাই নারুন বুড়া। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর রোজ সন্ধ্যায় বানাম (কেঁদরি) সহযোগ গান গাইতেন এবং গান গাইতে গাইতেই মারা

গেলেন—

সিঙগি সিঞা সিঙগি ত্রিদী লীড়হৗই চালাও এনা

ভারতে দিসম ফুরগীলেনা।

আঁকিলান জীতকিন দ দিসমকিন হামেটান হিন্দুস্থান, পাকিস্থান,

আঁদ বুনয়ীদ হড় হপন দলে হালে ডালে।

(তথ্য সংগ্ৰহ - ক্ষেত্রমোহন সরেন, হাতকাটা)

অর্থাৎ—কি রাত কি দিন, স্বাধীনতার লড়াই চলল দেশ স্বাধীনও হলো, অগ্রণী জাত দুটো দেশ লুটে নিল — হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান আর আমরা আদিবাসীরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম।

মানবিক এবং সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ইতিহাস আজও লেখা হলো না। কার্ল মার্কস যথার্থই লিখেছিলেন 'ভারত সমাজে কেন ইতিহাস নেই, অন্ততঃ জানো কোন ইতিহাস। ভারতে ইতিহাস বলে যা বলি সে শুধু একের পর এক বহিরাক্রমণকারীর ইতিহাস, যারা ঐ প্রতিরোধী অপরিবর্তমান সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিত্তিতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে (নির্বাচিত রচনাবলী মার্ক্স-এঙ্গেলস খণ্ডতে 7-১৪৪)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভারতবর্ষের বিকৃত ইতিহাসের কঠোর সমালোচনা করে লিখেছিলেন— “ভারতবর্ষে যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই তাহা ভারতবর্ষের নিশীথ কালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র দেশের ইতিহাস আমাদের স্বদেশকে আসন্ন করিয়া রাখিয়াছে।” ডক্টর প্রবোধকুমার ভৌমিক—'স্বাধীনতা আন্দোলনে আদিবাসীদের ভূমিকা পুস্তকের মঙ্গলাচরণে বলেছিলেন, ভারতের ইতিহাস বৃটিশ শাসক কোনদিনই জনগণের ইতিহাস রূপে প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেনি, কেননা এর পিছনে রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষমতা, দর্প, ঘটনাবলীর প্রকাশ ও প্রচার আর অপরাকে গর্ব করার এক সুচতুর প্রয়াস। ১৮৯৪ সালে চাইবাসা জার্মান মিশন থেকে যখন বিরসা মুণ্ডাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সেই সময় বিরসা মুণ্ডা ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর ইতিহাস বইটা ফেলে আসছিলেন। বন্ধুরা বইটা নিয়ে আনতে বললে বিরসা বলেছিলেন—যে ইতিহাস বইতে কালো মানুষের কথা লেখা নেই সেই ইতিহাস আমার কোন দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই—

তুমি জীবনের পাতায় পাতায় অদৃশ্য লিপি দিয়া

পিতামহদের কাহিনী লিখেছ

মজ্জায় মিশাইয়া

যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই তুমি তাহাদের কিছু ভোল নাই, 

বিস্মৃত যত নীরব কাহিনী

স্তম্ভিত হয়ে বও

ভাষা দাও তারে হে মুনি অতীত

কথা কও কথা কও।

জোহার।।

(এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত বক্তৃতার লেখরূপ)













0 Reviews